সম্পাদকীয়
চীন-ভারতের ভূমিকা
ত্রাণের জন্য রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ লাইন
রাজনীতি আর কূটনীতিতে আপন বলতে কিছু নেই। এখানে আপনের সমার্থক শব্দটি হচ্ছে স্বার্থ। স্বার্থ অনুকূলে থাকলে তোমার মতো আপন আর কেউ নয়। প্রতিকূলে গেলে আপন ভাইও বৈমাত্রেয় ভ্রাতায় পরিণত হয়। এটাই নিয়ম।
রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের বর্বরতম এবং পৈশাচিক হামলা ও নির্যাতনের পর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ সোচ্চার হলেও চীন ও ভারত মানবতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বর্বরতাকে সমর্থন দিয়েছে। আসলে রাজনীতি ও কূটনীতির গতি-প্রকৃতি কখন যে কোন দিকে বাঁক নেবে তা বলা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। যদি আমাদের জানা থাকে, স্বার্থই গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের চাবিকাঠি।
এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় ভারত ও চীন এখন মুখোমুখি। এখন এক চরম প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে।
প্রকৃত অর্থে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ এখানে মুখ্য কোনো বিষয় নয়। মূল বিষয় লুকিয়ে আছে অন্যত্র। অর্থনৈতিক স্বার্থ, বিনিয়োগ ও ভূরাজনীতির হিসাবনিকাশই এখানে আসল। মিয়ানমারে এ যাবৎ সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশটির নাম চীন। গত ৩০ বছরে এখানে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের বিনিয়োগ এখন পর্যন্ত খুব বেশি না হলেও ভারত তা বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় বিশেষ মনোযোগী এবং উৎসাহী। রাখাইন রাজ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করছে ভারত। মিজোরাম থেকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত সড়ক বানানোর পরিকল্পনাও রয়েছে দেশটির। চীনের প্রভাব বলয়ের মধ্যে থাকা জ্বালানি, খনিজ ও বনজ সম্পদে ভরা মিয়ানমার ভারত ও চীনের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা কেবল দেশ দুটির পক্ষেই বলা সম্ভব।
এই ঘটনা থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছুই শেখার আছে। যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো— অন্ধত্ব পরিত্যাগ করে বন্ধু নির্বাচন করা এবং রাজনীতিতে কেউই স্থায়ী বন্ধু নয়
আগের চার লাখ শরণার্থীর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরো সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। চরম অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে এই জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় না দিয়ে অথবা গ্রহণ না করে বাংলাদেশের জন্য আর কোনো পথ খোলা ছিল না। বাংলাদেশের সংস্কৃতিই হচ্ছে মানবিকতায় পরিপূর্ণ। অথচ গৌতম বুদ্ধের অনুসারী হয়েও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর যা করেছে তাকে পাশবিকতা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। মুক্তবাজার অর্থনীতি সম্ভবত পৃথিবীর সব মূল্যবোধকে গলা টিপে হত্যা করার পথে ক্রমশই যেন এগিয়ে চলেছে। গোটা বিশ্বের জন্য যা একটি অশনিসংকেতও বটে।
আমরা মনে করি, এই ঘটনা থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছুই শেখার আছে। যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো অন্ধত্ব পরিত্যাগ করে বন্ধু নির্বাচন করা এবং রাজনীতিতে কেউই স্থায়ী বন্ধু নয়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা। সর্বোপরি নিজেকে একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে বিনির্মাণ করা। তাহলেই হয়তো আমরাও এক দিন তর্জনী ঘুরিয়ে বলতে পারব, এই মুহূর্তেই মিয়ানমারের সব নাগরিককে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং মিয়ানমার তা করতে বাধ্য থাকবে। সম্ভবত এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভেতরের অংশে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নের একটি ভগ্নাংশ।
পিডিএসও/হেলাল