মাহমুদ আহমদ

  ২০ আগস্ট, ২০১৭

মানব ঐক্যতেই মুক্তি

মানুষ আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সমগ্র মানুষকে সামাজিকভাবে একতাবদ্ধ করার জন্যই মহান আল্লাহপাক যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। মানবজাতি হিসেবে কারো মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি এবং একই সত্তা থেকে সবার সৃষ্টি। যেভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রভু-প্রতিপালকের তাকওয়া অবলম্বন কর, যিনি একই সত্তা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ (সুরা আন নেসা, আয়াত : ১)। এখানে কোনো ধর্ম বা জাতির কথা বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে ‘হে মানুষ’ অর্থাৎ সব মানুষের কথা বলা হয়েছে। আবার বলা হয়েছে, ‘তিনি একই প্রাণ থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। এরপর তিনি তা থেকেই এর জোড়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আয যুমার, আয়াত : ৬)।

তাই একজন মানুষ সে যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন মানুষ হিসেবে সবাই একই সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই কাউকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। যেভাবে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, ‘আর মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে তারা মতভেদ করল।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ১৯)। আল্লাহতায়ালা ইচ্ছা করলে সবাইকে এক ধর্মেরই অনুসারী বানাতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি নিজেই যেহেতু মানুষকে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত করেছেন তাই আমাদের কোনো ধর্মের অনুসারীর প্রতি মন্দ আচরণ করা মোটেও ঠিক নয়।

পবিত্র কোরয়ানে বলা হয়েছে, ‘আর তোমার প্রভু-প্রতিপালক যদি চাইতেন অবশ্যই তিনি সব মানুষকে এক উম্মত বানিয়ে দিতেন। কিন্তু তারা সব সময় মতভেদ করতেই থাকবে।’ (সুরা হূদ, আয়াত : ১১৮)। তারপর আরো অন্যান্য স্থানে যেমন উল্লেখ রয়েছে, ‘আর আল্লাহ চাইলে তিনি তাদেরকে এক উম্মত বানিয়ে দিতেন, কিন্তু তিনি যাকে চান নিজ কৃপার অন্তর্ভুক্ত করেন। আর জালেমদের জন্য কোনো বন্ধুও নেই এবং কোনো সাহায্যকারীও নেই।’ (সুরা আশ শুরা, আয়াত : ৮)। ‘আর আল্লাহ যদি চাইতেন তিনি অবশ্যই তোমাদের সবাইকে একই উম্মতে পরিণত করে দিতেন। কিন্তু যে পথভ্রষ্ট হতে চায় তিনি তাকে পথভ্রষ্ট হতে দেন এবং যে সঠিক পথ পেতে চায় তিনি তাকে সঠিক পথ দেখান। আর তোমরা যা-ই করবে সে সম্পর্কে তোমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা আন নাহল, আয়াত : ৯৩)। ‘আর আল্লাহ যদি চাইতেন তোমাদের সবাইকে তিনি একই উম্মত করে দিতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন তা দিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করতে চান। অতএব তোমরা সৎকাজে পরস্পর প্রতিযোগিতা কর।’ (সুরা আল মায়েদা, আয়াত : ৪৮)। ‘নিশ্চয় তোমাদের এই উম্মত একই উম্মত এবং আমিই তোমাদের প্রভু-প্রতিপালক। অতএব তোমরা আমার ইবাদত কর।’ (সুরা আল আম্বিয়া, আয়াত : ৯২)। ‘আর জেনে রাখ, তোমাদের এ সম্প্রদায় একটিই সম্প্রদায়। আর আমি তোমাদের প্রভু-প্রতিপালক। অতএব তোমরা কেবল আমাকেই ভয় কর।’ (সুরা আল মোমেনুন, আয়াত : ৫২)।

পবিত্র কোরআনে উপরোক্ত বিষয়টি বারবার কেন উল্লেখ করা হয়েছে? নিশ্চয় এর কোনো বিশেষ কারণ রয়েছে। মহান আল্লাহ হচ্ছেন সব জ্ঞানের আধার। তিনি জানতেন যে, এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষ একে অপরের ধর্ম নিয়ে মতবিরোধ করবে, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, এক ধর্মের অনুসারী অন্য ধর্মের লোকদের তুচ্ছ জ্ঞান করবে। তাই আল্লাহ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি চাইলে এক উম্মতভুক্তই করতেন সবাইকে কিন্তু তিনি তা করেননি আমাদের পরীক্ষার জন্য। পবিত্র কোরআন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, আমরা যেন সব মানুষের প্রতি দয়াশীল হই। যেহেতু আমাদের সবার সৃষ্টির মূল একটাই। আল্লাহতায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাদের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছেন। আজকে সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায়, শুধু অশান্তি আর অশান্তি। এক ধর্মের অনসারী আরেক ধর্মের অনুসারীকে যেন সহ্যই করতে পারে না। মানবতা বলতে মনে হয় কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ অর্জনের জন্য ব্যস্ত। একে অপরের প্রতি নেই কোনো প্রেম-ভালোবাসা। আমরা কি পারি না সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে? দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসতে? আমরা কি পারি না ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’-এই কথাকে গ্রহণ করে নিতে? দেশের সম্পদকে নিজের সম্পদ মনে করতে? কেন পারব না, অবশ্যই চেষ্টা করলে আমরা পারব। আমরা সেই জাতি, যারা বুকের রক্ত বিলিয়ে দিয়ে লাল সবুজের পতাকাকে ছিনিয়ে এনেছিলাম। দেশপ্রেমের কারণেই সে দিন একাজ সম্ভব হয়েছিল। তাই দেশপ্রেম যদি আমাদের মাঝে না থাকে তাহলে কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। আমাদের এই শান্তির দেশকে আমরা যদি আবার শান্তিতে পরিণত করতে চাই তাহলে সব ধর্মের লোককে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে সবাইকে একে অপরের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তা হলেই না আমরা একই খোদার একই উম্মত বলে খোদার কাছে বিশেষ মর্যাদা লাভ করব। আমরা যদি আমাদের দোষ-ত্রুটিগুলোকে সংশোধনের চেষ্টা না করি তাহলে এমনও হতে পারে, আল্লাহ পাক আমাদের ধ্বংসও করে দিতে পারেন। আর যদি আমরা সংশোধনের চেষ্টা করতে থাকি তাহলে তিনিই আমাদের সাহায্য করবেন। যেভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমার প্রভু-প্রতিপালক কোনো জনপদকে অন্যায়ভাবে কখনো ধ্বংস করেন না যখন এর অধিবাসীরা সংশোধনের কাজে রত থাকে।’ (সুরা হূদ, আয়াত : ১১৭)।

মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টির পর দু’টি পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। একটি হলো ভালো আর অপরটি হলো মন্দ। যে ভালো কাজ করবে সে তার প্রতিদান পাবে আর যে মন্দ কাজ করবে সেও তার প্রতিদান পাবে। তিনি ইচ্ছে করলে সবাইকে মোমেন বানাতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। যেভাবে বলা হয়েছে, ‘আর তোমার প্রভু-প্রতিপালক যদি চাইতেন তাহলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই অবশ্যই এক সঙ্গে ঈমান নিয়ে আসত। তুমি কি তবে বল প্রয়োগে লোকদের মুমিন হতে বাধ্য করতে পার?’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৯৯)

আল্লাহতায়ালা ধর্মের ব্যাপারে কারো ওপর কোনো ধরনের বল প্রয়োগের অনুমতি দেননি। এ ব্যাপারে সবার স্বাধীনতা রয়েছে। আমরা যদি পবিত্র কোরআনের শিক্ষার ওপর আমল করি তাহলে কিন্তু আমাদের সমাজে কোনো ধরনের অরাজকতা থাকতে পারে না। আমরা জানি, আল্লাহতায়ালার সব নবী-রাসুলই সমাজে ভ্রাতৃত্ব গঠনের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। যেহেতু সব নবী-রাসুল একই ঐশী উৎস থেকে এসেছিলেন এবং তাদের শিক্ষাসমূহ কমবেশি একই রূপ ছিল। এছাড়া তাদের আবির্ভাবের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যও ছিল এক ও অভিন্ন-পৃথিবীতে আল্লাহর তৌহিদ এবং মানবের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করা। দেখা যায়, সব ধর্মের একই মূলনীতি আর তা হলো আল্লাহর তৌহিদের প্রচার।

দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যায়কবলিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। এমন পরিস্থিতিতে দলমত নির্বিশেষে সবার দায়িত্ব বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো, যার যেভাবে সম্ভব তাদের সাহায্য সহযোগিতা করা। তাই আসুন, আমরা সবাই সবাইকে ভালোবাসি এবং সব ধর্মের অনুসারীকে ভালোবাসি আর একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হই। আমরা যদি এমনটি করি, তবেই না আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ ও দেশ গড়তে পারব।

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

পিডিএসও/রানা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মানব ঐক্যতেই মুক্তি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist