ফয়জুন্নেসা মণি

  ২০ আগস্ট, ২০১৭

তুলে দিচ্ছি বিষের পেয়ালা

গর্ভাবস্থায় বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী খাওয়ার কারণে মা ও তার পেটের সন্তানটি মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৯৯ ভাগ। দেশে বছরে দুই লাখের অধিক লোক নতুন করে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতি বছর দ্বিগুণ হারে হাবাগোবা ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এসবের অন্যতম কারণ ভেজাল খাদ্য। তথ্য মতে, বাজারে প্রচলিত পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর শতকরা ৯৬ ভাগই বিষাক্ত এবং খাবার অযোগ্য। তাহলে কী খেয়ে বেঁচে আছি আমরা? দেশে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যসামগ্রীর অবাধ ব্যবহারে বছরে দ্বিগুণ হারে বিভিন্ন মরণব্যাধি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দেশে মরণব্যাধি মহামারী আকার ধারণ করবে বলে তাদের আশঙ্কা। কিডনি, লিভার, শিশু, গাইনি ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সময় থাকতে ভেজাল খাদ্যসামগ্রীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পদক্ষেপ এবং কঠোর আইন প্রয়োগ করা অনিবার্য। এ কেমন সমাজে বাস করছি আমরা, যেখানে মানবতা মনুষ্যত্ব চরমভাবে লাঞ্ছিত। বিবেক যেখানে অর্থের কাছে সমর্পিত। আমাদের প্রিয় সন্তান, পিতা-মাতাসহ আপনজনদের সুস্বাস্থ্য আর সুস্থ ও উচ্ছল ভবিষ্যতের জন্য ভালোবেসে প্রতিদিন যেন বিষের পেয়ালা তুলে দিচ্ছি তাদের মুখে। যা ভক্ষণ করে আমরা তিলে তিলে খুন হচ্ছি; খুন করছি জীবনীশক্তি। নৈতিক স্খলন ঘটেছে আমাদের সমাজের। বিবেক বলে কি আমাদের কিছুই নেই! তাহলে আমরা নিজেদের মানুষ দাবি করব কোন অধিকারে? লাভটাই কি আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়?

ডায়াবেটিস রোগী ব্যাপক হারে বৃদ্ধির জন্য ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত। কিডনি বিশেষজ্ঞদের মতে, ফরমালিনযুক্ত দুধ, মাছ, ফলমূল এবং বিষাক্ত রঙ মেশানো লাল আটা, চাল ও আলুসহ নানা ধরনের লোভনীয় ফাস্টফুড এ রোগের প্রধান উৎস। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তারাই এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিরোধ ক্ষমতা শিশুদের তুলনায় কিছুটা বেশি হওয়ায় তাদের কিডনিতে তা ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলছে। ফরমালিনযুক্ত দুধ পান করলে শরীরে হাড়ের জোড়ার দূরত্ব সৃষ্টি ও ব্যাক পেইনসহ শারীরিক বিভিন্ন জটিল সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শিশুদের নানা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পেতে পারে।

ভেজালবিরোধী অভিযানের সুবাদে আমরা জানতে পেরেছি রাজধানীতে এবং দেশের আনাচেকানাচে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নকল কারখানা। যেখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নকল ও ভেজাল পণ্য। রাজধানীর খাবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও নকল ওষুধ তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে সাধারণ খাদ্যদ্রব্য চাল, ডাল, আটা, মুড়ি থেকে শুরু করে শিশু খাদ্য গুঁড়ো দুধ, পাস্তুরিত তরল দুধ, দই, আইসক্রিম, চকলেট, জুস, জেলি, কোল্ডড্রিঙ্কস, মিষ্টি, ঘি, হোটেলের খাবার, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, মুরগি, ওষুধ, ডেক্সেট্রো মনো হাইড্রেট গ্লুকোজ, জর্দা, ওরাল স্যালাইন, ভোজ্যতেল, বেকারির খাদ্যসামগ্রী ও বিদেশি কসমেটিকসহ শতাধিক রকমের পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল খুঁজে পাওয়া গেছে। ওয়াসার পানির সঙ্গে সোডিয়াম সাইক্লোমেট, টেক্সটাইল রং, ফ্লেভার ও কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে জুস। বেকারিতে পাউরুটি, কেক, বিস্কুট, চানাচুর, পেটিস ও রোল তৈরিতে নাম ও লেবেলহীন বিষাক্ত রং, কেমিক্যাল, সোডিয়াম সাইক্লোমেট, ইউরিয়া সার ও দীর্ঘদিন ব্যবহার করা গাদযুক্ত পোড়া তেল, পচা ডিম ও মবিল ব্যবহার করা হয়। চানাচুর, সমুচা, শিঙ্গাড়া দীর্ঘ সময় মচমচে রাখতে সেগুলো মবিল দিয়ে ভাজা হয়। ডিমের আড়ত ও দোকানপাট থেকে পচা ডিম কিনে এনে বেকারিতে ও মিষ্টির কারখানাতে বিক্রি করা হয়। মিষ্টিতে টেক্সটাইল মিলের রং, পচা ময়দা, হোয়ে পাউডার, সোডিয়াম সাইক্লোমেট ব্যবহার করা হয়। পাম-অয়েল, গুঁড়ো হুইল পাউডার ও হোয়ে পাউডারের সঙ্গে গরুর চর্বি, রংদানা নামে বিষাক্ত কেমিক্যাল ও সিদ্ধ আলু পেস্ট করে মিশিয়ে তৈরি করা হয় ঘি। কলা ও আম পাকানো হয় কার্বাইড দিয়ে। মাছে ব্যবহার করা হয় লাশ পচন রোধকারী ফরমালিন। ডাই ব্যবহার করার ফলে নুডলস ও বিস্কুট মচমচে থাকে এবং স্যাঁতসেঁতে হয় না। দেশের অধিকাংশ খামারে গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ও খাবার সোডা। এর ফলে গরু দ্রুত মোটাতাজা হলেও এর মাংস মানুষের শরীরে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না দিলেও লিভার ও কিডনি ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের পরীক্ষকদের মতে, বিষাক্ত নকল ট্যাং ও চকলেট খেলে শিশু বা বয়স্ক যে কোনো মানুষের দ্রুত কিডনি নষ্ট, ক্যানসার, লিভার ব্যাধি, দীর্ঘমেয়াদি পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, শিশুদের হার্টের রোগ ও দৃষ্টিশক্তিও হ্রাস পেতে পারে। চায়নিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারকে সুস্বাদু করতে মাত্রাতিরিক্ত টেস্টিং সল্ট ব্যবহার মানুষের শরীরের জন্য বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ধরনের খাদ্য গ্রহণে গর্ভজাত শিশু বিকলাঙ্গ এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে। অবস্থাটা এমন যে, সন্ত্রাসীরা যেভাবে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে জীবন কেড়ে নেয়, এই হত্যাকা- আর খাবারে ভেজাল মিশিয়ে মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার মাঝে তেমন কোনো তফাৎ নেই। ভেজাল খাবারে বিষক্রিয়ার পরিণতির কথা ভাবলে মন বিষণœ হয়ে ওঠে। এভাবে খাবারে বিষ মিশিয়ে জাতিকে তিলে তিলে না মেরে, একসঙ্গে ডেকে নিয়ে মেরে ফেলাও অনেক ভালো! ভেজালকারীদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন, আপনি যে জিনিসটায় ভেজাল মেশাচ্ছেন এর বাইরে বাকি সব জিনিস আপনিও তো কিনে খাচ্ছেন, তাহলে আপনি কতটা নিরাপদ? কতটা নিরাপদ আপনার সন্তান?

এখন আমরা কী করব? খেয়ে পরে তো আমাদের বাঁচতে হবে। এখন বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতার। ভেবেচিন্তে, বুঝেশুনে খেতে হবে। বাইরের খাবার যথাসম্ভব কমিয়ে এবং এড়িয়ে যেতে পারলে ভালো। ফাস্টফুড যত কম খাওয়া যায় তত ভালো। যতটা সম্ভব বাসায় তৈরি খাবার খেতে হবে। ব্যবসায়ী সমাজ, উৎপাদনকারী এবং বিক্রেতাদের সচেতন করতে হবে যে-এই কাজটি একটি বড় রকমের অন্যায়, পাপ এবং এটি একটি রাষ্ট্রীয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কৃষকদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে, কৃষকরা যেন কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে অথবা কম ব্যবহার করে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে আগ্রহী হয়। তারা যেন প্রাকৃতিক পদ্ধতি যেমন- গোবর, ছাই এবং বাড়ির আবর্জনা দিয়ে তৈরি কম্পোস্ট সার জমিতে ব্যবহার করেন। এভাবে সব মহলে সচেতনতা বাড়াতে হবে। নিজে বাঁচতে এবং প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে এখন থেকেই প্রয়োজন জনসচেতনতা সৃষ্টি, সরকারি উদ্যোগ, কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের বর্তমান যা পরিস্থিতি সেখানে এক মাস, দুই মাস নয় সারাবছর অভিযান চলমান রাখতে হবে। সংবাদ প্রচারণা ও লেখালেখি চলমান রাখতে হবে। সামান্য জেল জরিমানা দিয়ে অপরাধীদের থামানো যাবে না। যারা খাবারে বিষ মেশায় তারা মানুষ খুনি। তারা প্রজšে§র শত্রু! যারা খাদ্যদ্রব্যে বিষ মেশায় তাদের শুধু জেল-জরিমানা নয়; সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান দিয়ে দ্রুত আইন বাস্তবায়ন করা হোক। কারণ পাঁচ, দশ, পঞ্চাশ হাজার বা লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে ভেজালকারীর যে আর্থিক ক্ষতি হয় আবারও ভেজাল মিশিয়ে সহজেই তারা তা পুষিয়ে নিতে পারে। সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করতে হবে। তাদের সামাজিক অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। জনসমক্ষে অপমানজনক শাস্তি দিয়ে তা মিডিয়াতে প্রচার করতে হবে। যাতে ওরা স্ত্রী সন্তানদের কাছেও ধিক্কার পায়। সমাজের মানুষ যেন তাদের ঘৃণা করে। এ শুধু আক্ষেপ নয়, ক্ষোভ, ক্রোধ এবং প্রার্থনা আমাদের।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

পিডিএসও/রানা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
তুলে দিচ্ছি বিষের পেয়ালা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist