এস এম মুকুল

  ১৮ আগস্ট, ২০১৭

প্রকৃতির বিপক্ষে গেলেই বিপদ

ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে প্রকাশিত ‘এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মানবজীবনে জলবায়ুর প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৩ শতাংশ ভূখন্ড সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে। আগামীতে বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব ২০ শতাংশ বাড়তে পারে। আয়তনে তুলনামূলক কম হলেও বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়লে ২০৮০ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ৬২ সেন্টিমিটার। ফলে সমুদ্র উপকূলে থাকা দেশটির প্রায় ১৩ শতাংশ ভূখন্ড বিলীন হয়ে যেতে পারে। বন্যার শিকার হতে পারে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ ভূমি। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ শতাংশ ভূমি সমুদ্রে বিলীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ সময়ের মধ্যে বন্যার শিকার হবে বাড়তি ৬ শতাংশ জমি। অস্বাভাবিক তাপমাত্রায় এ অঞ্চলের আবহাওয়া, কৃষি, মৎস্য, ভূমি ও সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য, নগর উন্নয়ন, অভিবাসন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তথ্যমতে, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। ১৯৯০-২০০৯ সালের মধ্যে সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি মেপে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। গবেষকদের ধারণা, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পানির উচ্চতা আরো বেড়ে যাবে এবং বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে নদী ও ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা আরো বৃদ্ধি পাবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে সুপেয় পানি। প্রকট সেচ সমস্যায় এই অঞ্চলে কমপক্ষে ২৯ লাখ দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকায় নেমে আসবে চরম দুর্দশা।

মানুষই দায়ী!

ভয়ানক খবর! মানবজাতির জন্য ভয়ানক খবর!! আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে! মানবজাতি বিলুপ্ত হওয়ার জন্য দায়ী থাকবে কিন্তু মানুষই। তার মানে কী? তার মানে আমরাই আমাদের ধ্বংস ডেকে আনছি! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি কথা। বেলজিয়ামে প্রকাশিত পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের খসড়া প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বাড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতিবছর আরো বেশি বন্যা, খরা, প্লাবন, সুনামি, ভূমিকম্পের মুখোমুখি হচ্ছে মানবজাতি। দেখা দিচ্ছে খাদ্যাভাব। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক প্রজাতি। খুবই ভাবনার বিষয়। কারণ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বিপুল হারে বাড়ছে। এর ফলে পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষের যে ভয়াবহ ক্ষতি হবে, তা পূরণ করতে লাগবে আরো শত শত বছর। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, পুরো মানবজাতি যদি ধ্বংস নাও হয়, তবে শত শত কোটি মানুষের মৃত্যু ঠেকানোর উপায় নেই। বিশ্বের গড় তাপমাত্রা যদি আর ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়ে, তবে সারা বিশ্বে ৪০-১৭০ কোটি মানুষ পরিবেশের বৈরী অবস্থায় পড়বে। ২০০ কোটি মানুষ খরার শিকার হবে। ২০-৩০ শতাংশ প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে পারে। গড় তাপমাত্রা ৭ থেকে ৯ ডিগ্রি বাড়লে পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং বিশ্বের পরিবেশ পরিস্থিতি ভয়াবহ। আর এর জন্য আমরা মানুষই দায়ী। আমরা তো নির্বিচারে গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলছি। বন-জঙ্গল বলতে এখন আর কিছুই নেই। বৃক্ষ ও বনে পশুপাখি আর কীটপতঙ্গের বসবাস। তাদের বসবাসের স্থান না থাকায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে পশুপাখি আর কীটপতঙ্গ। এই পশুপাখি কীটপতঙ্গরা ক্ষতিকর পোকামাকড় আর মৃত পশুপাখির দেহাবশেষ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। আমরা জেনে-শুনে সেই উপকারী বন্ধুদের আবাসস্থল গাছগাছরা কেটে শেষ করছি! ইশ, কত স্বার্থপর আমরা! কত যে বোকা!!

ষড়ঋতুর বাংলাদেশ আর নেই

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এ কথা এখন শুধু পাঠ্যবইতেই খাটে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। চিরচেনা বাংলাদেশের এ ছয়টি রূপই বাংলাদেশকে দিয়েছিল রূপসী বাংলার খেতাব। সময়ের বিবর্তনে এসে সব কিছুই পাল্টে যাচ্ছে। এখন আর ঋতুভিত্তিক বাংলাদেশকে চেনা যায় না। বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের আবহাওয়ার প্রকৃতি। এখন আর ছয় ঋতুর কোনো ঋতুকেই আলাদা করে চেনা যায় না। এক ঋতুতে আরেক ঋতুর বৈশিষ্ট্য দেখা দিচ্ছে। দেশে গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। কমে গেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। শীতে নেই শীতের প্রকোপ। বর্ষায় নেই বৃষ্টি। অথবা কখনো অনাবৃষ্টির কারণে খরা কিংবা অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা হচ্ছে। আবার অসময়ে বন্যা বা আগাম বন্যা, বৃষ্টি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফল।

জেগে উঠছে ঘুমন্ত দৈত্যরা

প্রকৃতি বিমুখ হওয়ার কারণে বাড়ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। পাহাড় ধসে পড়ছে। খরা হচ্ছে, বন্যা হচ্ছে—প্রকৃতির এসব বিরূপ আচরণের জন্য একমাত্র মানুষই দায়ী। আমাদের নদীগুলো মরে গেছে। পুকুর যা আছে তাও ভরাট করা হচ্ছে। নদী ও খাল খনন হচ্ছে না। বনের গাছ কেটে আমরা সাবাড় করে ফেলছি। গাছ কাটার আগে গাছ লাগাচ্ছি না। বন না থাকায় আমাদের পশুপাখিরাও বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করে আমরা জমির প্রাকৃতিক উর্বরাশক্তি নষ্ট করে ফেলেছি। মাটির বিষ পানিতে মিশে আমাদের মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। কল-কারখানা, যানবাহন ও ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, শব্দদূষণ, ট্যানারির বর্জ্য, নগরীর সাধারণ ও শিল্পবর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে বিষিয়ে তুলেছে পরিবেশকে। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, কারখানা ও খামার গড়ে তোলে বিনষ্ট করা হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। সর্বোপরি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে পরিবেশ। ফলে পরিবর্তন হচ্ছে আবহাওয়া ও জলবায়ু। এ কারণে ঘুমন্ত দৈত্যরা জেগে উঠছে। যার আলামত কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। ঘন ঘন ভূকম্পন হচ্ছে। ভর বর্ষায় তেমন বৃষ্টি নেই। শীতকালে হাড় কাঁপানো শীত নেই। তার পরও আমরা বুঝতে পারছি না যে, নিজেরা নিজের কতটা সর্বনাশ করছি। আবহাওয়াবিদদের মতে, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পাহাড় কাটার ফলে সেখানকার মেঘগুলো দেশের উত্তরাঞ্চলে সরে গিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে এবং একই সঙ্গে রাজশাহী, রংপুর অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রচুর বনায়নের ফলে সেখানে বৃষ্টিপাত কিছুটা বাড়ছে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তন আর এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কিন্তু আমরা নিজেরাই।

প্রকৃতির বিপক্ষে নয়, প্রকৃতিবান্ধব হতে হবে

সামনে ভয়ানক বিপদ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের এখনই উদ্যোগী হতে হবে। গাছ লাগিয়ে সবুজ বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। জনগণকে সচেতন হয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। না হলে এর ভয়াল পরিণতির শিকার হব আমরাই। বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা, মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পারলে এত বেশি পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইডসহ দূষিত গ্যাস পৃথিবীর বাতাসে ছড়াবে না। সমুদ্রতত্ত্ববিদ জেমস ম্যাককারথি বলেছেন, এ রকম ভয়ংকর খারাপ পরিস্থিতি নিশ্চয়ই তৈরি হবে না। কারণ আমরা কখনোই এত বোকা হতে পারি না। আমরা নিশ্চয়ই এ রকম বোকামি করব না। নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে মানুষ অবশ্যই সচেতন হবে—এমনটাই কাম্য।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রকৃতি,ষড়ঋতু,প্রাকৃতিক বিপর্যয়
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist