রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৭ আগস্ট, ২০১৭

আমেরিকা-কোরিয়া যুদ্ধ কি আসন্ন

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানান দিচ্ছে, উত্তর কোরিয়া-আমেরিকা ক্রমেই যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ভঙ্গুর এ পরিস্থিতিতে প্রতিদিন যেসব খবর প্রকাশ হচ্ছে তাতে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে এবং এমন ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে, যুদ্ধ অত্যাসন্ন। তবে এ চিন্তা যে যথেষ্ট শক্তিশালী এবং তাকে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। কেউ কেউ মনে করেন, বাগযুদ্ধের মাঝেই এ যুদ্ধকে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। তবে, বিশ্লেষকদের অনেকেই এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কের মধ্যেই আছেন। তারা মনে করছেন, পরিস্থিতি একটি ম্যাচবাক্সের মতো। তাতে সামান্য স্ফুলিঙ্গ হলেই জ্বলে উঠবে। র‌্যান্ড করপোরেশনের প্রতিরক্ষাবিষয়ক সিনিয়র বিশ্লেষক ব্রুস বেনেট বলেছেন, এখন বাস্তব বিষয়টি হলো কেউ একজন স্টুপিডের মতো ভুলটি করে বসবে। কারণ, যে কোনো ছোটখাটো উসকানিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তা সত্ত্বেও কেউ একজন যদি আগামীকাল কৌশলগত ভুল হিসাব কষে ফেলে তাহলেও যুদ্ধ অত্যাসন্ন নয় বলে মনে করেন কিছু বিশেষজ্ঞ।

উত্তর কোরিয়া যে মার্কিন মুলুকে আঘাত হানার মতো ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়েছে বলে প্রদর্শনী দিয়েছে, তার লক্ষ্য হচ্ছে ওয়াশিংটনকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখা। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, কিম পরিবার যদি বিশ্বাস করে যে যুক্তরাষ্ট্রের আঘাত আসন্ন, তখনই কেবল তারা পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করবে। কূটনীতির মাধ্যমে উত্তর কোরীয় নাগরিক এবং চীনা ও রুশ সরকারকে বোঝাতে হবে, কিম জং উনকে উৎখাত বা উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করা যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য নয়। বরং তার লক্ষ্য হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি মোকাবিলা করা।

তাছাড়া চীনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে এই প্রস্তাব দিতে পারে যে, বাজার সংস্কার ও বেসরকারীকরণের লক্ষ্যে তারা যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা চালিয়ে গেলে তাদের প্রণোদনা দেওয়া হবে। বহু বছর ধরে উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়াকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, তারা এই দুই দেশকে গোলাবারুদের বন্যায় ভাসিয়ে দেবে। কারণ, এরা উত্তর কোরিয়ার প্রথাগত ও পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে বাদসেধে ছিল। উত্তর কোরিয়ার নেতারা এমনভাবে চেঁচামেচি করছেন, যেন মনে হয়, ছোট আকৃতির ইয়াপি কুকুর শান্ত ও সহিষ্ণু রটওয়াইলার প্রজাতির কুকুরকে তাড়া করছে। ওদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দৃশ্যত নিজ দেশের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ভুলে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বুলি ধার করে মহা আড়ম্বরে ‘গুলি ও ক্রোধের’ (ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি) হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এমন আক্রমণ করা হবে, ‘যা পৃথিবী আগে কখনো দেখেনি।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে পৃথিবী পারমাণবিক বোমার বিভীষিকা দেখেছে, সে কারণে এসব কথা বিপজ্জনক।

উল্লেখ্য, জাপানে যে বোমা ফেলা হয়েছিল, তা উত্তর কোরিয়ার নির্মিত বোমার চেয়ে অনেক ছোট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা নিশ্চিন্তে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথা উড়িয়ে দিতে পারি না। ১৯৯৯ সালে এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা।’ আর এখন উত্তর কোরিয়া ‘নিউইয়র্ক সিটি ও ওয়াশিংটনের দিকে পারমাণবিক অস্ত্র তাক করার আগেই’ তিনি দেশটিকে নিবৃত্তিমূলক হামলার পরিকল্পনায় হাওয়া দিচ্ছেন।

যদিও সামরিক নেতৃত্ব এ ধরনের নিবৃত্তিমূলক সামরিক হামলার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। সে কারণে ট্রাম্পের মন্ত্রিসভাকে জোর দিয়ে বলতে হবে, উত্তর কোরিয়ার প্লুটোনিয়াম ও ইউরেনিয়ামভিত্তিক পারমাণবিক স্থাপনা ও অস্ত্র নিশ্চিহ্ন করে দিতে গেলে কত মানুষের জীবনহানি ঘটবে। এই সংখ্যাটা শুনে আমাদের মাথা দুলে উঠতে পারে। সম্ভবত লাখ লাখ দক্ষিণ কোরীয় ও মার্কিন নাগরিক মারা পড়তে পারেন। আর যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু জানে না উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনা, অস্ত্র, উপাদান ও বিজ্ঞানীদের কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সেহেতু বড় রকমের সামরিক অভিযান সফল নাও হতে পারে। এই অবস্থায় একমাত্র সমাধান হচ্ছে, বহুমুখী কৌশল প্রণয়ন করা।

২০১১ সালের শেষভাগে কিম জং উন যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তার তিনটি লক্ষ্য ছিল—ক্ষমতা সংহত করা, আন্তর্জাতিক শক্তি যাতে তার সরকারকে উৎখাত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে কিম বংশের দীর্ঘকালীন শাসন নিশ্চিত করা। উত্তর কোরিয়া এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে গুয়ামে মার্কিন ঘাঁটির কাছে চারটি মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথা বলেছে। বিবিসি অনলাইনসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার এ হুমকির কথা জানানো হয়। এর আগে গত বুধবার তারা বেশ তেড়েফুঁড়েই বলেছে যে, গুয়ামে মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর বিষয়টি বিবেচনা করছে তারা। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মার্কিন অবস্থান হচ্ছে গুয়াম।

একই সঙ্গে বিমান ও নৌঘাঁটি রয়েছে কোরীয় উপদ্বীপ আর দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যবর্তী এই স্থানে। উত্তর কোরিয়ার বার্তা সংস্থা কেসিএনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গুয়ামে মার্কিন অবস্থানে মাঝারি থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথা সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করছে পিয়ংইয়ং। এই ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম। এমন ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে তা হবে রাজগোখরার লেজে কোপ মারার মতো একটা বিষয়। পরিণতি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ যে ডেকে আনবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এর আগেও উত্তর কোরিয়া অনেক হুমকি-ধমকি দিয়েছে। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানার মতো সক্ষমতা অর্জনের কথাও জানান দিয়েছে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানোর দুঃসাহস প্রদর্শন এটাই প্রথম। ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রসঙ্গে বলতে পারি, ক্যাপিটল হিল ও ২০০৮ সালে উত্তর কোরিয়া সফরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ১৯৯৪ সালে যে কাঠামোর মতৈক্য হয়েছিল, তা উত্তর কোরিয়ার প্রতারণার আগ পর্যন্ত কাজ করেছে। অন্যদিকে ওয়াশিংটন কূটনীতি, চাপ বা প্রণোদনা দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসাতে পারেনি। ২০০০-এর শুরুর দিকেও নিষেধাজ্ঞা কাজ করেছে, যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্ত চুক্তি না করেই তা বাতিল করে। সে কারণে এই অবস্থায় সবচেয়ে ভালো নীতি এ রকম হবে যে, তাকে একদিকে যেমন নিরোধক ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনি অন্যদিকে চাপ, কূটনীতি, প্রণোদনা এসবও প্রয়োগ করতে হবে। আবার অতীতের সফলতা ও ব্যর্থতা থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা উন্নত করতে হবে।

অন্যদিকে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক মহড়া চালাতে হবে। এর সঙ্গে পারমাণবিক সুরক্ষার কথাও ভাবতে হবে। জাতিসংঘ নতুন করে উত্তর কোরিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করায় তার ওপর চাপ আরো বাড়বে। শেষমেশ, জাতিসংঘ আস্থা নির্মাণ করে উত্তর কোরিয়া কথিত ‘মানবিক’ ব্যাপারে অগ্রগতি অর্জন করতে পারে অর্থাৎ পিয়ংইয়ংয়ে আটক মার্কিন ও জাপানি বন্দিদের মুক্ত করা, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের পারিবারিক মিলন ও কোরীয় যুদ্ধে নিহত মার্কিন সেনাদের দেহাবশেষ প্রত্যাহার করা। ট্রাম্প এখন কৌশলের চারটি মাত্রা একত্রে প্রয়োগ করতে পারেন : নিরোধক, চাপ, কূটনীতি ও প্রণোদনা। সেটা শুধু উত্তর কোরিয়ার হুমকি সামাল দিতে নয়, দেশটিতে অর্থনৈতিক সংস্কার ও প্রকৃত পরিবর্তন আনতেও তিনি সেটা করতে পারেন। হাওয়াই প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং ইউএস প্যাসিফিক কমান্ডের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের সাবেক পরিচালক কার্ল শুস্টারের মতে, যদি ঘটনা সেটাই হতো তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে রাখা হতো ডেফকন বলে পরিচিত অবস্থায়। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় থাকাকে বোঝানো হয় ডেফকন অবস্থা। শুস্টার বলেন, এমন ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে এবং প্রকাশ্যে আসবে। এরইমধ্যে তারা সামরিক মহড়ার পর বড় বড় সব সমরাস্ত্র নাড়াচাড়া শুরু করেছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আমেরিকা-কোরিয়া যুদ্ধ,আন্তর্জাতিক,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist