এ.এফ.এম ফৌজি চৌধুরী

  ১৬ আগস্ট, ২০১৭

মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিব

বর্ষপরিক্রমায় আবার ফিরে এসেছে সেই দিন। ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিবিজড়িত শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে একদল ঘাতক তার কয়েক রাজনৈতিক সহকর্মী ও নিকট আত্মীয়সহ সপরিবারে তাকে হত্যা করে। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা।

এদেশের মানুষের অধিকারের জন্য সারা জীবন সংগ্রামকারী স্বাধীনতার রূপকার ও স্থপতি বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীর এই দিনে দেশের মানুষ পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করল তাকে। তার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এই দেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি সারা জীবন ছিলেন সোচ্চার। এ জন্য তিনি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আন্দোলন সংগঠিত করেছেন, আন্দোলন ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, হাসিমুখে কারাবরণ করেছেন। কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারেনি। জীবনের দীর্ঘ একটা সোনালি সময় তাকে কাটাতে হয়েছে কারাগারের অভ্যন্তরে। তার নামে দেওয়া হয়েছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। একাত্তরে তাকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির বন্দোবস্ত করার কাজও চলেছে। কিন্তু কোনো কিছুই তাকে এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের পথ থেকে এতটুকু বিচ্যুত করতে পারেনি। অকুতোভয় এই নেতা সংগ্রামের পথ ধরে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন সমগ্র দেশের মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা এবং এই সুবাদে গোটা বিশ্বে এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি।

এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দেওয়ার জন্যই তিনি ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়েছেন সংগ্রামকে। এরই একটি পর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগের ছয় দফা রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু তাকে পাকিস্তানে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয়নি। নানা টালবাহানা শুরু হয়। বাঙালি জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে চিরতরে দমনের জন্য পাকিস্তানি শাসকরা শুরু করে চক্রান্ত। ২৫ মার্চ বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সত্যিকার অর্থেই গণমানুষের নেতা। গণমানুষের প্রাণের ভাষাকে সার্থকভাবে রূপায়িত করাই ছিল তার রাজনীতির মর্মকথা। এ দেশের মানুষের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষার সার্থক রূপ দিয়ে গেছেন তিনি।

দেশকে গড়ে তোলার কাজ যখন চলছে সে সময়ে, পঁচাত্তরের কালরাতে জল্লাদরা হত্যা করল এই মহান নেতাকে। তার হত্যার যাতে বিচার করা না যায় সেজন্য দেওয়া হয়েছিল কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বাতিল হয় এ আইন। হত্যার বিচার কাজ চলল। নিম্ন আদালতে বিচারের রায়ে স্বঘোষিত খুনিদের মৃত্যুদন্ড হয়েছে। উচ্চতর আদালতেও বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠছে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার কাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করার। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে তা পালন করা হতো, দিনটিতে থাকত সরকারি ছুটি। সরকার পরিবর্তনের পর পতাকাবিধি সংশোধন করে বলা হয়েছিল, ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস অথবা সরকারের কোনো ঘোষণা ছাড়া অন্য কোনো দিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিবসে তার প্রতি জাতীয়ভাবে শোক প্রকাশ করতে না দেওয়ার লক্ষ্যেই এটি করা হয়েছে কি না—তখনই সে প্রশ্ন উঠেছে।

ব্যক্তি জীবনে যেমন, জাতীয় জীবনেও অতীতের স্মৃতি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে আলোকিত করে। অতীতের দিকে তাই মাঝে মাঝে ফিরে দেখা দরকার। কালের ব্যবধান ভেদ করে মিথ্যাচার কখনই ইতিহাসের মর্যাদায় টিকে থাকতে পারে না। মাকড়সার জালের মতো মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতির জাল অতি সুকৌশলে তৈরি করা হলেও শেষ পর্যন্ত এসব কৌশল ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালের প্রজন্ম মাটি খুঁড়ে তথ্য উদ্ধার করে। গবেষকরা বিশ্বের গ্রন্থকেন্দ্রগুলোতে বছরের পর বছর কুয়াশার আবরণ ছিন্ন করে সত্য উদ্ধারের লক্ষ্যে বিনিদ্র রজনী যাপন করেন। সত্য আপন মহিমায় আবার নতুন সূর্যের মতো উদয় হয়। আমাদের পাশের ইন্দোনেশিয়ার কথাই ধরা যাক। প্রথমে ডাচ সাম্রাজ্যবাদের প্রচারযন্ত্র এবং স্বাধীনতাউত্তর সময়ে পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যম ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক সুকর্ন সম্পর্কে অবিরাম বিরূপ প্রচারণা চালিয়েছে। একজন মহান নেতার দোষত্রুটি থাকতেই পারে, কিন্তু ওই কারণে তার নেতৃত্বের গুণাবলি ও জাতির নবজন্মে তার অবদানকে কি অস্বীকার করা যায়?

সুকর্ন ইন্দোনেশিয়ার বিশাল দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটি একটি বিশাল অর্জন। একমাত্র ভাষার প্রশ্নে সুকর্ন যে দূরদৃষ্টি ও উদারতা দেখিয়েছেন, সে জন্যই তিনি ওই দেশের ইতিহাসের একজন মহান নেতা হিসাবে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু সম্পদলোভী বৈদেশিক শক্তি ও স্থানীয় সামরিক বাহিনীর যোগসাজশে শুরু হলো চরিত্র হনন ও ইতিহাস বিকৃতি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচারণার সঙ্গে এই প্রচার অভিযানের অদ্ভুত মিল লক্ষ করা যায়। জাতির তথাকথিত ত্রাণকর্তা বলে পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর অতি প্রিয়ভাজন ব্যক্তি জেনারেল সুহার্তো আজ ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, কিন্তু সুকর্ন পুত্রী মেঘবতী দেশের প্রেসিডেন্টের আসন অলঙ্কৃত করেছেন। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক সুকর্নকে জাতি স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। মিথ্যাচার ও ইতিহাসবিকৃতি পরাজিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করেও আমরা দেখি, সুকৌশল প্রচারণা একটা মিথ্যার আবরণ কিছুদিনের জন্য সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু সময়ের প্রবাহ যেন অতিরঞ্জন ও সাজানো ইতিহাসকে ক্রমেই ধুয়েমুছে নির্মল করে ফেলে।

অবশ্য যারা বঙ্গবন্ধুকে অতিমানবের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান, আমরা তাদের দলে নই। অসাধারণ গুণাবলির অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন দোষত্রুটিসম্পন্ন একজন মানুষ। মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি। এটাই তার গৌরব। সর্বগুণের আধার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তার আসল গৌরব ক্ষুণ্ন হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ছিল কালজয়ী সাহিত্যিক ও সৃজনশীল প্রতিভা। বাঙালি মানসকে তিনি গড়ে দিয়ে গেছেন, আধুনিক চিন্তা-চেতনার জন্য প্রস্তুত করে গেছেন। যে দুর্লভ সম্পদ তিনি উপহার দিয়ে গেছেন সেই ঋণ বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী আগামী বহু শতাব্দীতেও শোধ করতে পারবে না। ঠিক তেমনিভাবে শেখ মুজিব মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সুপরিচিত পরিবেশ থেকে উঠে এসে এমন এক অবিস্মরণীয় অর্জন করে গেছেন, যা ভাবলে অবাক হতে হয়। অসাধারণ দেশপ্রেম, আপসহীন সততা, অনমনীয় মনোবল এবং গভীর দূরদৃষ্টি দিয়ে তিনি আমাদের একটি জাতিরাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেছেন।

স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে বাঙালিদের কোনো কালেই ছিল না। এই অমূল্য সম্পদ যিনি আমাদের দিয়ে গেছেন তার স্মৃতি কি এই জাতি কখনো ভুলে যেতে পারে! বাঙালিরা কি এতই অকৃতজ্ঞ হবে? আমরা নিজেদের এত ক্ষুদ্র ভাবতে পারি না। তাই বিশ্বাস করি, বাঙালি চরিত্রে মহৎ গুণাবলি নিশ্চয়ই সুপ্ত রয়েছে। ১৯৭১ সালে আমরা তার কিছু পরিচয় পেয়েছি। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য লাখ লাখ মুক্তিপাগল তরুণ হাসিমুখে মৃত্যুর মুখেও সামনে এগিয়ে গেছে। এসব ঘুমিয়ে থাকা গুণাবলিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভৌগোলিক অবস্থান-এসবের ভিত্তিতেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল যেন অটল থাকে। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও পশ্চাৎমুখিতার ভিত্তিতে এ রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। বঙ্গবন্ধু অবশ্যই ভাষা সংস্কৃতিভিত্তিক এই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের মহান প্রতিষ্ঠাতা।

জাতীয় শোক দিবসে এই মহান নেতাকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে। আমরা ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সোনালি স্বপ্ন নিয়েই বাঁচতে চাই। জয় হোক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। আততায়ীর গুলি তাকে বিনাশ করতে পারবে না, স্বাধীন বাঙালির হৃদয়ে তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বঙ্গবন্ধু,কলাম,আওয়ামী লীগ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist