বিশ্বজিত রায়

  ০৮ আগস্ট, ২০১৭

বঙ্গবন্ধু : তুমিই বিষাদসিন্ধু

আগস্ট ১৯৭৫! এই মাসটিতে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও ন্যক্কারজনক অধ্যায়। ধ্বংস করা হয়েছিল একটি জাতির মূল স্তম্ভকে। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাতিঘরটি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল চিরতরে। নির্মম পৈশাচিকতায় নিঃশেষ করা হয় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতাকে। বুলেটভর্তি রাইফেল ঝাঁজরা করে দেয় পাহাড়সম মানুষটির বুক। হায়েনার ন্যায় নিকৃষ্ট ভঙ্গিমায় ক্ষতবিক্ষত করা হয় মুক্তিদাতার মুক্তপ্রাণ। শকুনের বাঁকানো ঠোঁট আর মানুষখেকো জানোয়ারের হিংস্র থাবায় অনন্তকালের জন্য লুটিয়ে পড়েন স্বাধীন বাংলার স্থপতি। ঢুকরে কেঁদে ওঠে রক্তে রঞ্জিত ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর। একদিকে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি, অন্যদিকে শেষ রাতের নীরব প্রকৃতির করুণ ক্রন্দন মিশে হয় একাকার। সবার অজান্তেই অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে রাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, কেমন ছিল সে সময়কার পরিবেশ। বর্ষার বিদায় শরৎ শুরুর প্রকৃতিতে হয়তো বিরাজ করছিল মেঘ-জোছনার উড়ন্ত মিলনের দৃশ্য নতুবা অন্ধকার রাতে ঝিঁঝি পোকার বিরামহীন সুর আর শোকার্ত নিশাচরদের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি। সবকিছুই কি সঙ্গী হয়েছিল জাতির পিতার ওপর চালানো বীভৎসতায়। হ্যাঁ, ঘাতকদের বিকৃত উল্লাসের কাছে বেদনার্ত প্রকৃতির চূর্ণ-বিচূর্ণ হৃদয় ছিল অনেকটা অসহায়। নীরবে-নিভৃতে শেষ শ্রাবণের গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি কাঁদিয়েছিল বাংলার প্রকৃতিকে। শান্তির অগ্রদূত এই মানুষটির বক্ষে বিদ্ধ প্রতিটি বুলেটই যেন আঘাত করছিল চারপাশের সবকিছুতে। পরাধীনতার পিঞ্জরে বন্দি বঙ্গজননীর সম্মান রক্ষা এবং কোটি প্রাণের দুঃখ লাঘবে যার অবদান ইতিহাসে বিরল, সেই দৃশ্যমান আলোকবর্তিকার প্রতি এমন নৃশংস বর্বরতা দেখে কি কোনো মা নিজেকে সামলাতে পারেন? না পারেননি। গভীর ঘুমে অচেতন পৃথিবী যেমন কেঁদেছিল, তেমনি বাংলা মা-ও বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল তার বক্ষ মৃত্তিকায় জন্ম নেওয়া পাষণ্ড কুসন্তানদের অনৈতিক ও অবিচারসুলভ আচরণ দেখে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ এবং নিজ সন্তানের নিথর দেহ বুকে রেখেই ক্রন্দনে ক্রন্দনে বঙ্গজননী পৃথিবীকে শুনিয়েছে বিপন্ন মানবতার করুণ আর্তনাদ। গভীর ঘুমে মগ্ন বাঙালির কল্পনায় তখনও কি কড়া নেড়েছিল তাদের জনক হারানোর কোনো বার্তা। মিছে কোনো কল্পনাতেই হয়তো কেটেছে তাদের রাত। ফিঙে পাখির অস্থির কলরব অন্য যেকোনো ভোরের চেয়ে একটু ভিন্ন ভাব যোগ করেছিল প্রকৃতিতে। স্তম্ভিত বাংলাদেশ, কেঁদে ওঠে বাঙালি জাতিসত্তা।

যে জাতির জন্য এত ত্যাগ এবং জীবন-মরণের কঠিন পরীক্ষায় বারবার মুখোমুখি হয়েছে চেতনা দীপ্ত সেই মহান পুরুষ। অগ্নিমশাল হাতে নিয়ে বারবার বাঙালি জাতিকে সামনে এগোবার পথ দেখিয়েছে। সেই জাতির অবিবেচক, অকৃতজ্ঞ কিছু কুলাঙ্গারের হাতে নিশ্চিহ্ন হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কোনো বাঙালি তার বুকে ছুরি চালাতে পারে, এমনটি বিশ্বাস করতেন না বিশাল মনের অধিকারী এই মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষটি। বাঙালির প্রতি ভালোবাসা এবং মমত্ববোধের গভীর নিশানা তার প্রতিটি বক্তব্য ও কথায় ফুটে উঠত। ‘সাড়ে সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করো নি’ রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত এই উক্তি আওড়িয়ে তিনি বলেছিলেন—কবির কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। বিশ্বকবির কাব্যিক কথার সূত্র ধরে রাজনীতি ও মানবতার কবি বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে প্রকৃত মানুষের যে ছাড়পত্র দিয়েছিলেন তা কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি আমরা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পার্বত্য অঞ্চলে অপারেশনের দায়িত্ব পালন করা ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান তার প্রণীত গ্রন্থ ফ্যান্টম্স্ অব চিটাগংয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন—‘আমি লক্ষ্য করলাম, তার বাসায় কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। সব রকমের মানুষ সময়-অসময়ে যখন-তখন এসে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার চাইত। তার সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকদের কোনো বাছবিচার নেই। এ কথা তুলতেই তিনি বললেন, আমি জাতির জনক। দিন বা রাতে কোনো সময়েই তো আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না।’ একটি জাতির প্রতি কতটুকু বিশ্বাস থাকলে একজন নেতা এমন উত্তর দিতে পারেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করেছিলেন বাঙালি জাতিকে। শুধু বিশ্বাস নয়, মনে-প্রাণ উজাড় করে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন এই জাতির প্রতি। সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু একে তেমন গুরুত্ব দেননি তিনি। এছাড়াও নিরাপত্তার খাতিরে সরকারি গণভবনে উঠে যাওয়া উচিত বলে একাধিকবার মত দিয়েছিলেন বহুজন। তিনি তাদের বলতেন, গণভবনে চলে গেলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হবে। তাই তিনি তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, শত্রুদের কাছ থেকে বেঁচে এসেছেন, বাংলার মানুষ তাকে ভালোবাসে, তাই কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করবে না।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্তে মার্চের ১৭ তারিখ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে ধানমণ্ডির বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জানিয়েছিলেন—‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে বিমর্ষ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু।’ দুঃখী মানুষের দুঃখী রাজা বঙ্গবন্ধুর কাছে নিজের চাওয়া-পাওয়া ছিল অতি তুচ্ছ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ৪১টি বছর অতীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকী পালন করবে জাতি। যাদের জন্য ত্যাগের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন এই মহানপুরুষ, তাকে আমরা কতটুকু চিনতে পেরেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর বিশালতা যদি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করত ঘাতক দল তাহলে কি এমন নিষ্ঠুরভাবে গুলি চালাতে পারত তার বুকে? পাষ- নরপিশাচরা না চিনলেও ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মালরো সূক্ষ্মভাবে চিনেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। ১৯৭৩ সালে মালরোর সঙ্গে আলোচনায় অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ আচমকা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মুজিব পারবেন তো একটি নতুন রাষ্ট্র তৈরি করতে?’ তীক্ষè ত্বরিত জবাব এলো, ‘অবশ্যই, যদি না আপনারা শিক্ষিতরা, বুদ্ধিজীবীরা তাকে মেরে ফেলেন।’ শেষ পর্যন্ত জাতির অকৃতজ্ঞ চরিত্রগুলোই মালরোর সন্দেহের সফল বাস্তবায়ন ঘটায় পঁচাত্তরের পনের আগস্ট। মিসরের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি নাসেরের সুহৃদ এবং বিখ্যাত ‘আল আহরাম’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ হেইকল বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট নাসের যেমন সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, তেমনি শেখ মুজিব প্রবক্তা ছিলেন সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের। গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার মতো রাজনৈতিক ভিশনের অধিকারী আরেকজন নেতা আমি দেখি না।’

আমি পঁচাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম। তাই দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাই শত-সহস্রকোটি মাইল দূরত্বে থেকেও, ‘পিতা তোমাকে সালাম’। তোমার সৃষ্টিতে মাথা নত হয়ে আসে। ঋণ শোধের কোনো পথ খোলা নেই। যদি পার ক্ষমা কর, ক্ষমা কর জাতিকে। তুমি যে জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ এবং বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, বিপ্লবের এক অমর কবিতা, চেতনার অগ্নিমশাল।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা,স্মরণ,শেখ মুজিবুর রহমান
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist