আবু তাহের

  ২৪ জুন, ২০১৭

চীনে মুসলিমদের অস্তিত্ব সংকট

আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে সাহাবি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর হাত ধরেই ইসলামের সূচনা ঘটেছিল চীনে। সময়টা ছিল ৬১৬-১৮ খ্রিস্টাব্দ। তার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন সাঈদ (রা.), ওহাব ইবনে আবু কাবসা (রা.) ও অন্য সাহাবিরা। এরপরও ৬৩৭ সালের দিকে দ্বিতীয়বার হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) চীন সফর করেন। এবারের সঙ্গী ছিলেন হজরত সুহায়লা আবু আজরা (রা.), উয়াইস আল কারানী (রা.) ও হজরত হাসান ইবনে তাবিত (রা.)। এরই মাঝে ইসলামে প্রচার প্রসার শুরু হয়। ৬৫০ সালের দিকে হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) খলিফা হজরত ওসমান (রা.)-এর পক্ষ থেকে এক রাষ্ট্রীয় চিঠি চীনের বাদশাহ গাওজংয়ের নিকট পেশ করেন। মূলত এটা ছিল গাউনজোহি শহরে একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ এবং তা বাদশাহ গাওজং নির্মাণও করেছিলেন। এটি ছিল একটি স্মরণীয় মসজিদ, যদিও আধুনিক সেক্যুলার অনেক ইতিহাসবিদ সাহাবি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর চীন আগমনের কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী।

ধীরে ধীরে চীনের ইসলামের প্রসার হতে লাগল। বাড়তে লাগল মুসলমানদের সংখ্যা। চীনের একটি বড় শহর হল সং। ১০৭০ সালের দিকে এখানকার অধিপতি সেনজং বুখারা থেকে প্রায় ৫৩০০ জন মুসলমানকে তার শহরে আমন্ত্রণ জানান স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য। তারা এসে সং এবং ইয়েনচিনে (যা বর্তমানে বেইজিং) বসবাস শুরু করেন। এভাবেই বিস্তৃতি লাভ করে ইসলাম সুদূর চীনে। এই যুগকে বলা যায় চীনে ইসলামের স্বর্ণযুগ। চীনের বিশাল অংশ জুড়ে বসবাস শুরু করে মুসলমানরা। আর মুসলমানদের এই সংখ্যাধিক্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় মোঙ্গল শাসকদের। শুরু হয় আক্রমণ, দমন, নিপীড়ন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চেঙ্গিস খান।

আপাতত সেই ইতিহাসের দিকে যাচ্ছি না। মুসলমানদের চোখে জল গড়ায়। আর সেই জলে দুঃখের সাগর সৃষ্টি হয় বর্তমান চীনে। একসময়কার ক্ষমতাসীন মুসলমানরা চীনে বর্তমানে কতটা নির্যাতিত, নিপীড়িত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চীন সরকার নানা রকম কঠোরতার নজির স্থাপন করেছে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। সম্প্রতি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখা নিষিদ্ধ করেছে দেশটি। কিন্তু এ নিয়ম ভঙ্গ করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রোজা রাখায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করেছে স্থানীয় প্রশাসন। জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করে আসছে চীন সরকার।

জিনজিয়াং প্রদেশটির সঙ্গে মিশে রয়েছে রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারত। বিভিন্ন সময়ে জিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেছে চীন সরকার।

বিগত দিনে চীনের এই জিংজিয়াংয়ে প্রদেশের রাজধানী উরুমকিতে বোরখা নিষিদ্ধ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। দ্য টেলিগ্রাফের বরাত দিয়ে এই সংবাদ জানিয়েছে দ্য ডন। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা জিনহুয়া জানায়, মৌলবাদ বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই এই অঞ্চলে বোরখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, এই এলাকায় প্রায় ৩১ লাখ মানুষের বাস। জিংজিয়ান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উইঘুর সম্প্রদায়ের বাস, যাদের পূর্বসূরিরা মূলত পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং কাজাখস্তান থেকে আসা। জিনহুয়া তাদের সংবাদে জানায়, বোরখা উইঘুর নারীদের ঐতিহ্যগত কোনো পোশাক নয় এবং তা বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোয় নিষিদ্ধ।

সম্প্রতি চীনে বেশ কিছু সংঘাতের ঘটনা ঘটে, বেইজিং যাকে ‘ইসলামিক সন্ত্রাস’ বলে আখ্যা দিয়েছে। দেশটির বেশ কিছু বিশেষজ্ঞও বলেছেন, এই সংঘাতগুলো মূলত উইঘুর এবং হ্যান চাইনিজদের মাঝে দ্বন্দ্বের কারণে ঘটেছে। দেশটির নেতৃত্বস্থানীয়রা বলছেন, ধর্মান্ধতা তাদের দেশকে রক্তপাতের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে বলে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলো। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এভাবে বোরখা নিষিদ্ধ করা মূলত উইঘুর সম্প্রদায়ের অধিকারে হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

স্থানীয়দের ধর্মীয় অনুভূতিকে দুর্বল করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নারীদের হিজাব পরিধানে এবং পুরুষদের দাড়ি রাখায় বাধা প্রদান করা, সরকারি চাকরি এবং শিশুদের মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা দেওয়া, রমচান মাসে কেউ রোজা রাখল কি না তা পর্যবেক্ষণ করা। বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের বিভিন্ন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে। চাকরি ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিশুর নাম রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ের মুসলিমরা। ওই অঞ্চলে সদ্যোজাতদের ইসলামী নাম রাখায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। ‘ভুল নাম’ রাখলে শিশুকে শিক্ষা ও অন্যান্য সরকারি সুবিধা দেওয়া হবে না বলেও হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

দ্য গার্ডিয়ান জানায়, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের কর্মকর্তারা নিষিদ্ধ নামের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে ইসলাম, কোরআন, সাদ্দাম, মক্কা- এ ধরনের নাম এবং দেশটির কমিউনিস্ট সরকারের নীতির বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চীনের মোট ১ কোটি ৩০ লাখ মুসলিমের মধ্যে অর্ধেকই বাস করে এই প্রদেশে।

সরকারি এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শিশুদের নিষিদ্ধ নাম রাখলে বাড়ির নিবন্ধনও দেওয়া হবে না। যে কোনো সামাজিক সেবা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা অধিকার পাওয়ার জন্য এই নিবন্ধনটি অপরিহার্য। তবে নিষিদ্ধ নামের পুরো তালিকাটি এখনো প্রকাশ করা হয়নি। আরো কোন কোন ধরনের নাম নিষিদ্ধ করা হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এখানে মুসলিমদের মদ বিক্রি করতে বাধ্য করছে চীন সরকার। চীনের মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়াং প্রদেশের একটি গ্রামে রেস্টুরেন্ট এবং দোকানের মালিকদের মদ এবং সিগারেট বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে রেডিও ফ্রি এশিয়া (আরএফএ)।

দক্ষিণ শিনজিয়াং প্রদেশের আকতাশ গ্রামের কমিউনিস্ট কমিটির কর্মকর্তা আদিল সুলাইমান আরএফএ কে বলেন, যেহেতু কোরআনে মদ্যপান হারাম তাই ২০১২ সাল থেকে স্থানীয়দের ঘৃণার হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক দোকান মালিক মদ বিক্রি করা পরিহার করেছে। তিনি বলেন, স্থানীয় উইঘুর সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে দুর্বল করার জন্য একটি ক্যাম্পেইনে নেমেছি আমরা। তার অংশ হিসেবেই মদ বিক্রি করতে দোকান মালিকদের বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি জানান, যারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে তাদের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হবে, ব্যবসা স্থগিত করা হবে। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

যদিও মেলবোর্নের লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা জাতিগত নীতি বিশেষজ্ঞ জেমস লেইবোল্ড বলেন, এ ধরনের ঘোষণা জাতিগত উত্তেজনা বৃদ্ধি করে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না চীন সরকারের। মুসলমানদের রক্তে সিক্ত হয়ে এক হোলি খেলায় মেতে উঠেছে চীনারা। আর তারই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে তারা একের পর এক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

চীনা সরকারের এই পদক্ষেপগুলো একপেশে। দেশের সব জায়গায় উন্নতির ছোঁয়া লাগলেও এই প্রদেশগুলো রয়ে গেছে সেকেলে। নাগরিক বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই প্রদেশের মানুষেরা আতঙ্কে থাকে প্রতিক্ষণ। শিশুদের সরকারি স্কুলে ভর্তি না করা, পারিবারিক পরিকল্পনা নীতিমালার অন্তর্গত না করা এক চরম বৈষম্য।

নিত্যনতুন আইন আর নিপীড়নের বেড়াজাল কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়াটা এখন অনেকেই ভুলে গেছে। আর এই বিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই চাপা পড়ে যায় চীনা সরকারের কঠোর নীতি আর গোপনীয়তার কারণে। তারপরও অনেক সময় উন্মোচিত হয় নানান খবর। কিন্তু বিশ্বমোড়লরা বরাবরের মতোই দেখেও না দেখার ভান করেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ও আরব বিশ্বের অবস্থাও একইরকম।

উইঘুর মুসলমানদের এই দুর্দশা অনেক পুরনো। আন্তর্জাতিক এবং গার্হস্থ্য রাজনৈতিক, মতাদর্শিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণগুলোর ফলে উইঘুরদের জন্য প্রচ- দুঃখের সৃষ্টি হয়, বিশেষত ১৯৯০ সাল থেকে। উইঘুর প্রতিনিধিদের গ্রেফতার, এমনকি অভিযুক্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে অনেক। জিনজিয়াং আজ উইঘুর রাজনৈতিক বন্দিদের সঠিক সংখ্যাটি কেউ জানে না। তাই এটি কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে কয়েকটি বিক্ষোভ যা চীনা সরকার দমন করে রক্তাক্ত পরিণতির বিনিময়ে। উইঘুরস এবং চীনা সরকারের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত খোলা দ্বন্দ্ব ৫ জুলাই ২০০৯ তারিখে ঘটেছে, যেখানে শত শত উইঘুর নিহত, গ্রেফতার হয়।

মূলত চীন সরকারকেই এই সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। মুসলিম এই বিশাল সম্প্রদায় নিজেদের চীনের অধীন মনে করলেও সরকার তাদের বিচ্ছিন্ন মনে করছে। এতে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়বে বৈ কমবে না। তৈরি হবে নানা সঙ্কট। যা অদূর ভবিষ্যতে চীনকে আরো কঠিন অবস্থার সম্মুখীন করবে।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চীন,মুসলিম,অস্তিত্ব,সংকট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist