বাহালুল মজনুন চুন্নু
অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ
আজ ২৩ জুন। এই দিনে ঐতিহাসিক দুটি ঘটনা ঘটে এই বাংলায়। ১৭৫৭ সালের এই দিনে এ দেশীয় কয়েকজন বিশ্বাসঘাতকের কারণে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যই কেবল অস্তমিতই হয়ে যায়নি, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মানসে সাম্প্রদায়িতকতার বীজ বুননের প্রচেষ্টাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর ঠিক ১৯৮ বছর পর স্বাধীনতার অস্তমিত সূর্যকে আবারও ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং সেই সঙ্গে সম্প্রসারিত সাম্প্রদায়িক সামাজিক কাঠামোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে ঐতিহ্যিক অসাম্প্রদায়িক কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মূল কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিজে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ছিলেন বলেই আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করতে পেরেছিলেন। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন, ‘আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’ এই সত্যকে ধারণ করেই আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছে। সৃষ্টিলগ্ন থেকে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের যে ঝাণ্ডা উড়িয়ে এসেছে এই দলটি, শত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পেরিয়েও সেই ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে। দলটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশকে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির দেশে পরিণত করার চেষ্টাকে কেবল রুখেই দেয়নি, অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংবিধানকেও সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে।
প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে নানা ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষের সম্মিলনে বাঙালি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের অপূর্ব দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। ‘রাজনীতি ধর্মনীতি নহে’, ‘পরধর্ম নিন্দা নিষিদ্ধ, ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ ইত্যকার বাণীগুলো রাঢ়, সূক্ষ্ম, বঙ্গ, গৌড়, সমতট, গঙ্গারিড্ডি, বরেন্দ্র, তাম্রলিপি, হরিকেল, সুবর্ণগ্রাম এবং পুণ্ড্র নগররাষ্ট্রের অন্যতম অনুসৃত রাষ্ট্রনীতি ছিল, যা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক এবং ব্যক্তিজীবনে চর্চিত হয়েছিল অত্যন্ত নিবষ্টতার সঙ্গে; যার ফলে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ বজায় ছিল সমগ্র ভারতবর্ষে। এজন্য বাংলা তথা ভারতবর্ষ সর্বমানবের মহামিলন তীর্থ উল্লেখ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারততীর্থ কবিতায় বলেছিলেন, ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন-শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হলো লীন।’ কিন্তু দুর্ভাগ্য মধ্যযুগের পর হতে কিছু কুচক্রী মানুষের স্বার্থবাদী কর্মকাণ্ডের কারণে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ এবং ‘মৌলবাদ’ নামক এই দুটি প্রপঞ্চ বাঙালি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি নানা ভাবধারা, চিন্তাচেতনা ও রাষ্ট্রনৈতিক নানা প্রপঞ্চ কাজ করেছে। ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুলনীতির কারণে এই দুটি প্রপঞ্চ অগ্নিরূপ ধারণ করে, যার ফলে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সৃষ্টি হয় জাতিতে জাতিতে অবিশ্বাস।
এ কারণে নজরুল তার ছুৎমার্গ প্রবন্ধে আঁকুতি জানিয়ে লিখেছেন, ‘হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার মহাগগনতলের সীমাহারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া মানব তোমার কণ্ঠের সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফোটাইয়া বল দেখি, আমার মানুষ ধর্ম। দেখিব, দশদিকে সার্বভৌম সাড়ার স্পন্দন কাঁপিয়া উঠিতেছে। মানবতার এই মহাযুগে একবার গন্ডি কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি মানুষ, তুমি সত্য।’ এতদসত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতেই দেশ বিভাগ ঘটে যায়। কিন্তু তার পরও একটি কথা সত্য যে, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ কখনোই বাঙালির মূলচেতনা ও ভাবধারাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি, যা পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনোপীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই তারা পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন-শোষণের স্টিমরোলার চালানো শুরু করে। আঘাত হানে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। মুসলিম লীগবিরোধী কোনো কথা বললেই ‘শির কুচাল দেঙে’ কথাটা উচ্চারিত হওয়া শুরু হয়। এই কারণে বাঙালির মনে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির অল্প দিন পর হতেই ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। আর সেই সঙ্গে নবজাত পাকিস্তানের জায়মান অবস্থা থেকেই পাকিস্তান মুসলিম লীগের এক ধরনের ভঙ্গুর সূচনা পরিলক্ষিত হয়।
বঙ্গবন্ধুসহ মুসলিম লীগের কতিপয় প্রগতিশীল তরুণ সদস্য ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থাৎ দেশ বিভাগের মাসখানের পরই ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেন, ‘আমি বললাম, এর (গণতান্ত্রিক যুবলীগের) কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা করা, যাতে কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হয়, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করে—যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা। অনেকেই এই মত সমর্থন করল...।’ এই গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনই ছিল পূর্বানুসৃত সাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতির স্থলে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের পথপ্রদর্শক। সাতচল্লিশের ডিসেম্বরে মুসলিম লীগের করাচি অধিবেশনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অসাম্প্রদায়িক জাতীয় দলের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। একদিকে কট্টর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি, আরেকদিকে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী তরুণ গোষ্ঠী। ওই বছরের জুন মাসে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী তরুণ গোষ্ঠী ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাশ লেনের রোজ গার্ডেন হলরুমে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে শামসুল হক কর্তৃক লিখিত মূল দাবি নামক পুস্তিকায় পাকিস্তান রাষ্ট্র্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের দাবি ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরা হয়। ওই সম্মেলনের প্রথম দিনে অর্থাৎ ২৩ জুন তারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে, যা ছিল পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এই দলটির মূলনীতি।
তিনশ প্রতিনিধি নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুুসরণ করে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে চল্লিশ সদস্যবিশিষ্ট অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করা হয়। তৎকালীন সংগ্রামী যুবনেতা শেখ মুজিব কারাগারে থেকেই মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে দলের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেদিন এই দলটির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যৎ স্বপ্নের জাল বোনা শুরু হয়েছিল। ওই বছরের ২৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের অন্যতম সংগঠকে পরিণত হন। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হওয়ার পর তিনি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে দলকে নিয়ে যেতে থাকেন অনন্য উচ্চতায়। আওয়াম শব্দের অর্থ জনগণ। আওয়ামী লীগ জনগণের লীগ তথা দল হিসেবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ দেশের মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার এবং শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করে দেয়। আপৎকালীন সময় উত্তীর্ণ হলে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য জাতির সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে দলটি।
এরপরের বছর শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করা হলে এর তীব্র বিরোধিতা করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান শাসনতান্ত্রিক পরিষদে তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি হয়নি।’ তার এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তার এবং আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য আবারও প্রমাণিত হয়ে যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা সেখানেও অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ ছিল মুখ্য একটি বিষয়। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারির ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর এই রাষ্ট্রের ভিত্তি ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ ওই বছরের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ২৫ বছর ধর্মের নামে জুয়াচুরি, শোষণ, বেইমানি, খুন, ব্যভিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’ বাংলাদেশ সরকার প্রণীত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে ধরা হয়, যার মাধ্যেমে বিশ্বেদরবারে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ ক্ষেত্রে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অনন্য অসাধারণ। এই দলের নেতাকর্মীরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বলেই তাদের পক্ষে অসাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র গঠনের কাজকে এগিয়ে নেওয়া সহজ হয়েছে। ধীরেন দত্ত, মনোরঞ্জন ধর, ফণীভূষণ মজুমদার, সুধাংশু শেখর হালদার, চিত্ত ছুতারের মতো ব্যক্তিত্ব আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ছিলেন, যা দলটির অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যরই প্রমাণ।
লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পিডিএসও/হেলাল