শফিকুল ইসলাম খোকন

  ২১ জুন, ২০১৭

নিরাপদ যাত্রায় বাড়ি ফেরা

ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অনেককে ঢাকায় বসবাস করতে হয়, যাদের সবারই কোনো না কোনো গ্রামে বা মফস্বল শহরে রয়েছে স্থায়ী বাড়ি। ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে গিয়ে সবার সঙ্গে তারা ঈদের আনন্দ উপভোগ করবে-এটাই স্বাভাবিক। এই অদম্য বাসনা যেখানে সুরের ধারায় প্রবাহিত হওয়ার কথা, সেখানে মন থাকে সার্বক্ষণিক আতঙ্কে! বাড়িতে আসলেই সুস্থভাবে, নিরাপদভাবে যাওয়া সম্ভব হবে কি না? ছয় ঘণ্টার পথ কত ঘণ্টায় শেষ হবে? এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন ভিড় করে মনে। তবু আশা থাকে, যেভাবেই হোক যেতেই হবে। এই হলো ঘরমুখো মানুষের ঈদে ফেরার বাস্তবতা।

প্রতি ঈদে নাড়ির টানে মানুষ বাড়ি ফেরে; ছুটে যায় নিজ বাড়িতে পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্যে। কারণ বছর শেষে আনন্দের দিনটি সবাই একসঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবে। আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষেও পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে মানুষ ছুটছে নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশে। কিন্তু শিকড়গামী মানুষের উদ্বিগ্ন মনে আশার সঞ্চার করতে এগিয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। তাদের এ বাড়ি ফেরার জন্য বাস-ট্রেন-লঞ্চ ইত্যাদি সুনিশ্চিত ও নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতেও চাই কর্তৃপক্ষের কঠোর তত্ত্বাবধান। ঈদের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ঘরমুখো মানুষের মধ্যে বাড়ি ফেরা নিয়ে ততই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বাস ও লঞ্চের টিকিট অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বাড়তি টাকা আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লোকাল বাস, ট্রাক এবং ট্রেনের ছাদ বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছে তারা। টার্মিনালগুলোতে শুরু হয়েছে ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের টিকিট নিয়ে বাণিজ্য। এক কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে ছুটছে অন্য কাউন্টারে। প্রতিটি কাউন্টারে বাড়ছে ঘরমুখো যাত্রীদের বিড়ম্বনা। বেশিরভাগই কাউন্টারের টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে। এখন ঈদের টিকিট যেন সোনার হরিণ। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও যাত্রী হয়রানি এবং ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় মার্কা লঞ্চ এবং গাড়ি রাস্তায় নেমে পড়েছে। এবারের ঈদেও চলাচল করবে দক্ষিণাঞ্চলে হাজারের অধিক ফিটনেসবিহীন লঞ্চ। যা ইতোপূর্বে মেরামত কর হয়েছে। মেরামত শেষ হলেও বিড়ম্বনার শেষ নেই। এ যেন এক অদ্ভুত চক্রের মধ্যে বসবাস।

শুধু দুর্ঘটনার ভয় নয়, রয়েছে নৌ এবং সড়কপথে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি। সারা বছরই নৌ এবং সড়কপথে ডাকাতি, চাঁদাবাজি হয়ে থাকে কমবেশি। কিন্তু ঈদে হঠাৎ করেই ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পায়। ইতোমধ্যেই বৃদ্ধি পেয়েছে নগর, মহানগর ও মহাসড়কে ছদ্মবেশী লোকদের আনাগোনা। যাত্রী নিরাপত্তার পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রতিবছর ঈদের মৌসুমে ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যায়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সড়কপথে যাতায়াত বেশি হলেও দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক এবং নৌপথে বেশি যাতায়াত করে মানুষ। ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলী, সদরঘাট লঞ্চটার্মিনালসহ বিভিন্ন টার্মিনাল থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চ-স্টিমারসহ বাস-ট্রেনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যথেষ্ট দুর্বল। এ কারণে নৌ এবং সড়কপথে ডাকাতি-চাঁদাবাজির ঘটনায় ঈদে ঘরমুখো মানুষেরা পথে আতঙ্কিত থাকেন। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আতঙ্ক আর ঝুঁকি নিয়েই যাত্রীরা গন্তব্যে পাড়ি দেন। পুলিশ ও বিআইডব্লিউটির দেওয়া তথ্যমতে, গত ৬ বছরে নদীপথে অর্ধ-সহস্রাধিক ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। গত দশ বছরে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হয়েছেন যাত্রী, লঞ্চ শ্রমিক, আনসারসহ অর্ধ শতাধিক ব্যক্তি। এ সময় একাধিকবার পুলিশ ও আনসার সদস্যদের অস্ত্র লুটের ঘটনাও ঘটে। ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা মেঘনা নদীতে ভয়াবহ ডাকাতির শিকার হয়েছে এমভি হিমি, এমভি তিন কন্যা, এমভি মায়ের দোয়া, এমভি দুই ভাই, এমভি জুঁই এমভি শরাইল, এমভি নুরে জামান, এমভি সাগর সুলতান, এমভি শাহ পরান, এমভি মতিহার, এমভি নড়িয়াস, এমভি মিশুসহ অসংখ্য জাহাজ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৬ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে গেছে অন্তত ৬ হাজার ৫৫ মানুষের প্রাণ। ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় এসব মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৯১৪ জন। হাত-পা বা অন্য কোনো অঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ৯২৩ জন। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫০০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬০০ জন নিহত ও ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত হয়েছেন।

ঢাকা মেট্রো পুলিশের তথ্যানুযায়ী গত ১৫ বছরে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭০ হাজার। এতে মারা গেছেন ১৫ হাজার মানুষ। অন্যদিকে বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ সেলের হিসাব মতে ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪২ হাজার ৪৫৭টি। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩৩ হাজার ৪৫ জন। আহত হয়েছেন ২৯ হাজার ৭৮৭ জন। সরকারি হিসাবে প্রতিদিন মারা যান ১২ জন। বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চের মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ১২ লাখ মানুষ দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এ হার ৪০-৫০ গুণ বেশি। একটি দুর্ঘটনায় যদি একটি পরিবারের একজন কর্মক্ষম লোকও মারা যান, তাহলে সেই পরিবারের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কোনো কোনো সময় পুরো পরিবারটিকেই পথে বসতে বাধ্য হয়।

নৌপথে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ ও লাখ লাখ টন পণ্য পরিবহন হলেও আজো গড়ে ওঠেনি আধুনিক নৌপরিবহন ব্যবস্থা। মুনাফার আশায় কোনো কোনো অসাধু মালিক নিজের চেষ্টায় রাজনীতিবিদ এবং সরকারের কিছু উচ্চপর্যায় অসাধু লোকের যোগসাজশে বিভিন্ন রুটে কিছু বিলাসবহুল লঞ্চ সার্ভিস চালু করলেও স্বাধীনতাপরবর্তী ৪০ বছরে প্রণীত হয়নি নৌপরিবহন নীতিমালা। এ কারণে সরকারি উদ্যোগে যাত্রীসেবার মান বাড়ানো কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। নৌযাত্রীদের জন্য এখনো চালু হয়নি দুর্ঘটনার ঝুঁকি কিংবা মৃত্যুবীমা। অন্যদিকে সরকারের অদূরদর্শিতা ও উদাসীনতার সুযোগে দেশের প্রায় সব রুটেই বিপুলসংখ্যক ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন লঞ্চ চলাচল করছে। সারাদেশে প্রায় ২০ হাজার নৌযান চলাচল করলেও বেআইনিভাবে চলাচলরত নৌযানের সংখ্যা অন্তত ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার। ফলে নৌরুটে যাত্রীরা প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। বিশেষ করে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলগামী যাত্রীরা বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। বিগত বছরগুলোতে অনেকবার নৌরুট এবং সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে না। সর্বশেষ মেঘনা ট্র্যাজেডি নিয়ে সরকার, বিআইডব্লিউটি এবং মিরসরাই ও মানিকগঞ্জের সড়ক দুর্ঘটনায় বিআরটিএর বোধোদয় হওয়া উচিত।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও সাধ পূরণে যদি তাদের যাত্রাপথকে নিরাপদ করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে হয়তো এমন বুকফাটা কান্না, লাশের মিছিল এবং স্বজনদের আহাজারি আমাদের দেখতে হতো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আসলে যার স্বজন চলে যায় তিনিই কেবল হারানোর যন্ত্রণা কী তা উপলব্ধি করতে পারেন। সত্যি কথা বলতে কি, নিরাপত্তা বিধানে যারা যে অবস্থানে আছেন তারা তাদের সঠিক দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট নন বলেই এত দুর্ঘটনা। আমাদের সব ক্ষেত্রে দায়িত্বে গাফিলতির ভাব থেকেই যাচ্ছে। সরকারের একার পক্ষে কোনো কিছুই মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। নিজ নিজ দায়িত্ব বোধ থেকে আমাদের এসব দুর্ঘটনা রোধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা উচিত।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাড়ি ফেরা,ঈদুল ফিতর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist