reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২০ জুন, ২০১৭

সাদ্দামের ফাঁসির সময়ে কেঁদেছিলেন যে মার্কিন সেনারা

কোনো দেশ কিংবা ব্যক্তির ওপর হামলে পড়ার আগে ওই দেশ কিংবা ব্যক্তিকে ভয়ঙ্কর রূপে উপস্থাপন করা পশ্চিমা দেশগুলোর অন্যতম কৌশল। এই কাজটা ভালোভাবে সম্পন্ন করে পশ্চিমা গণমাধ্যম। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ছিলেন এই যৌথ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় শিকার।

ইরাকে হামলার আগে বলা হয়েছিল, দেশটিতে ‘ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র’ রয়েছে। আর দেশটির প্রেসিডেন্ট বিশ্বের জন্য হুমকি। যদিও সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেয়ার এতোদিন পরেও সেই কথিত অস্ত্রের আর সন্ধান মেলেনি।

‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’ নামে ২০০৩ সালে ইরাকে হামলার মধ্য দিয়ে দুনিয়ায় এক নরক প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। ডিসেম্বরে গ্রেফতার করা হয় প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে। এরপর ২০০৪ সালের জুন মাসে তাকে ইরাকের শিয়া অন্তবর্তী সরকারের কাছে তুলে দেয়া হয় কথিত বিচারের জন্য। জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাদ্দাম হোসেনকে পাহারা দিয়েছিলেন ১২ জন মার্কিন সেনা। ফাঁসি কার্যকরের পর লাশ হস্তান্তর পর্যন্ত তারা সাদ্দামের সঙ্গী ছিলেন।

এই প্রহরী সেনাদের একজনের বই নিয়ে বিবিসি হিন্দি'র রেহান ফজলের এক প্রতিবেদন বিবিসি বাংলা প্রকাশ করেছে। ওই বইতে উঠে আসে সাদ্দাম হোসেনের বন্দিদশার দিনগুলো ও তার ব্যক্তিত্বের কিছু দিক।

ওই ১২ মার্কিন সেনা গ্রেফতার হওয়ার আগে যে সাদ্দাম হোসেনের 'বন্ধু' ছিলেন, সেটা মোটেই নয়। কিন্তু তারা সাদ্দামের শেষ সময়ের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারাই ছিলেন সাদ্দামের সঙ্গে।

মার্কিন ৫৫১ নম্বর মিলিটারি পুলিশ কোম্পানির ওই ১২ জন সেনা সদস্যকে 'সুপার টুয়েলভ' বলে ডাকা হতো। তাদেরই একজন উইল বার্ডেনওয়ার্পার একটি বই লিখেছেন- 'দা প্রিজনার ইন হিজ প্যালেস, হিজ অ্যামেরিকান গার্ডস, অ্যান্ড হোয়াট হিস্ট্রি লেফট আনসেইড' নামে। বাংলা করলে বইটির নাম হতে পারে 'নিজের প্রাসাদেই এক বন্দি, তার আমেরিকান প্রহরী- ইতিহাস যে কথা বলেনি'।

বইটিতে বার্ডেনওয়ার্পার স্বীকার করেছেন, তারা যখন সাদ্দাম হোসেনকে জল্লাদদের হাতে তুলে দিলেন ফাঁসির জন্য, তখন তাদের ১২ জনেরই চোখে পানি এসে গিয়েছিল।

বার্ডেনওয়ার্পার তারই এক সেনা-সঙ্গী রজারসনকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘আমরা কখনো সাদ্দামকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হত্যাকারী হিসাবে দেখিনি। তার দিকে তাকালে নিজের দাদুর মতো লাগত অনেক সময়ে।’

তিনি লিখেছেন, নিজের জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাদ্দাম তাদের সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করতেন। ওই ব্যবহার দেখে বোঝাই যেত না যে সাদ্দাম হোসেন কোনো এক সময়ে একজন অত্যন্ত নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন।

সাদ্দামের দরবার সাদ্দাম হোসেনকে একটা চমক দেওয়ার ইচ্ছা ছিল ১২ প্রহরী সেনার সবার। পুরনো, ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র থেকে একটা ছোট টেবিল আর চামড়ার ঢাকনা দেওয়া একটা চেয়ার নিয়ে আসা হয়েছিল। টেবিলের ওপরে ইরাকের একটা ছোট পতাকাও রাখা হয়েছিল।

বার্ডেনওয়ার্পার লিখেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম জেলের ভেতরেই সাদ্দামের জন্য শাসনকাজ পরিচালনার মতো একটা অফিস তৈরি করতে। যখন সাদ্দাম ওই ঘরটায় প্রথমবার গিয়েছিলেন, একজন সেনা সদস্য হঠাৎ খেয়াল করে যে টেবিলের ওপরে ধুলো জমে আছে। সে ধুলো ঝাড়তে শুরু করেছিল।’

ওই আচরণটা সাদ্দামের নজর এড়ায়নি। চেয়ারে বসতে বসতে তিনি মুচকি হেসেছিলেন। তারপর থেকে তিনি রোজ ওই চেয়ারে এসে বসতেন। তার নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত সেনা প্রহরীরা সবাই সামনের চেয়ারগুলোতে বসতেন, যেন সাদ্দাম নিজের দরবারে বসেছেন। নিরাপত্তা রক্ষীরা চেষ্টা করত সাদ্দামকে খুশি রাখতে। তার বদলে সাদ্দামও সবার সঙ্গে হাসি-মশকরা করতেন।

কয়েকজন রক্ষী পরে বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন, তারা বিশ্বাস করতেন- 'যদি তাদের কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়, তাহলে সাদ্দাম তাদের বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনও বাজি রেখে দিতে পারেন।’

যখনই সময়-সুযোগ পেতেন, তখনই সাদ্দাম হোসেন পাহারার দায়িত্বে থাকা রক্ষীদের পরিবারের খোঁজ-খবর নিতেন।

নিজেদেরই এখন হত্যাকারী মনে হচ্ছে

বার্ডেনওয়ার্পারের বইটাতে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যে বিষয়টার উল্লেখ রয়েছে সেটা হলো- সাদ্দামের মৃত্যুর পরে তার প্রহরীরা রীতিমতো শোক পালন করেছিলেন, যদিও তিনি আমেরিকার কট্টর বিরোধী ছিলেন।

প্রহরীদেরই একজন অ্যাডাম রজারসন বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন, ‘সাদ্দামের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরে আমার মনে হচ্ছে আমরা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নিজেদেরই এখন তার হত্যাকারী বলে মনে হচ্ছে। এমন একজনকে মেরে ফেললাম আমরা, তিনি যেন আমাদের খুব আপনজন ছিলেন।’

সাদ্দামের ফাঁসির পরে যখন তার মরদেহ বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন সেখানে জমা হওয়া শিয়ারা মৃতদেহের ওপরে থুতু ছিটিয়েছিল। ওই ঘটনা দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল আমেরিকান সেনারা।

বার্ডেনওয়ার্পার লিখছেন, ওই নোংরামি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তারা সবাই। বিশেষ করে যে ১২ জন তার শেষ সময়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। তাদেরই মধ্যে একজন ওখানে জমা হওয়া লোকজনের কাছে হাতজোড় করে তাদের থামাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দলের বাকিরা তাকে টেনে সরিয়ে নেয়।

ওই ১২ জনের অন্যতম স্টিভ হাচিনসন সাদ্দামের ফাঁসির পরেই আমেরিকার সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন। হাচিনসন এখন জর্জিয়ায় বন্দুক চালনা আর ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং দেওয়ার কাজ করেন।

তার মনে এখনো ক্ষোভ রয়েছে। কারণ সেদিন যেসব ইরাকি সাদ্দামের মৃতদেহকে অপমান করছিল, তাদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে না পড়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল তাদের।

সাদ্দাম হোসেন কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত আশা করতেন যে তার ফাঁসি হবে না। কিন্তু ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঈদুল আজহার দিন রাত ৩টার দিকে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়েছিল।

এরপর সাদ্দাম হোসেনকে জানানো হয়েছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে। এই কথাটা শোনার পরে সাদ্দামের ভেতরের সব বিশ্বাস ভেঙে পড়েছিল। তিনি চুপচাপ গোসল করে ফাঁসির জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছিলেন।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সাদ্দাম,ফাঁসি,মার্কিন সেনা,কেঁদেছিলেন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist