রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৭ জুন, ২০১৭

ওভার কনফিডেন্সেই ডুবলেন থেরেসা মে

আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচন দিয়ে বড় রকমের ঝামেলায় পড়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) আলোচনা শুরুর পর এই নির্বাচন তাকে হতাশ করেছে। ব্রিটেনের ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের প্রত্যাশা ছিল, জনগণ তাকে ব্যাপক সমর্থন দিয়ে পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সাহায্য করবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো, আগের চেয়ে বেশ কয়েকটি আসন কমেছে তার দল কনজারভেটিভ পার্টির। এ কারণে সরকার গঠন নিয়েই তাকে পোহাতে হচ্ছে নানামুখী ঝামেলা। অন্য দিকে দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন প্রথম নির্বাচনেই সফলতার মুখ দেখেছেন। নির্বাচনে আসন বেড়েছে তার দলের, এক মাস আগেও যা কেউ চিন্তা করেনি। এটিকে করবিনের জাদুকরী নেতৃত্ব হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা দেশটির ভবিষ্যৎ রাজনীতির বাঁক বদলে দিতে পারে। এ ছাড়া ব্রিটেনের এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় প্রভাবটি সম্ভবত পড়তে যাচ্ছে ব্রেক্সিটের ওপর। অনেকে মনে করছেন, এই নির্বাচনের পর ব্রিটেনের পক্ষ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের আলোচনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হতে পারে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বদলে যেতে পারে আগের কঠোর অবস্থান। ব্রিটেনের নির্বাচনে কাদের জয়-পরাজয় ঘটল, এ কথাটি কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলব, তরুণ প্রজন্মের জয় হয়েছে। পরাজয় ঘটেছে প্রবীণ প্রজন্মের। জয় হয়েছে প্রগতিশীলতার, পরাজয় ঘটেছে সম্মিলিত প্রতিক্রিয়াশীল পরাশক্তির। এই শক্তি গঠিত বিগ মিডিয়া, বিগ বিজনেস এবং এসটাবলিসমেন্টের একটা বড় অংশের সম্মিলনে। ব্রিটেনের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা এই অপশক্তির সম্মিলিত অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হননি। দলবেঁধে জেরেমি করবিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টিকে ভোট দিয়েছেন। এবার প্রথম দফাতেই তারা টোরি দলকে ক্ষমতা থেকে হটাতে পারেননি। কিন্তু তাদের নখর দন্ত ভেঙে দিয়েছেন। থেরেসা মে এখন উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটি দলের (ডিইউবি) ১০ সদস্যের সমর্থন নিয়ে মাইনরিটি গভরর্নমেন্ট গঠন করতে যাচ্ছেন। কিন্তু এই সরকারের আয়ু এবং থেরেসা মের নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সবাই সন্দিহান।

ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের মতো করবিনবিদ্বেষী সান্ধ্য দৈনিকটি পর্যন্ত স্বীকার করেছে, ব্রিটেনের ১৮ থেকে ৩৫ বয়সী তরুণ ভোটাররা দলবেঁধে লেবার পার্টিকে ভোট দিয়েছে। আর ৬৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বের ভোটাররা ভোট দিয়েছে টোরি দলকে। পরিণতি, নির্বাচনে করবিন নেতৃত্বের নৈতিক জয় এবং টোরিদের দুর্গে বিরাট বিপর্যয়। বিগ মিডিয়াগুলো এতদিন পর্যন্ত ঢাক পিটিয়েছে থেরেসা মের নেতৃত্বে টোরিদল ভূমিধস বিজয়ের অধিকারী হবে এবং করবিন একজন নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য নেতা। তার নেতৃত্বে লেবার পার্টি কোনো দিন নির্বাচনে জয়ী হবে না। তাদের এই প্রচারণায় ভবি ভোলেনি। নির্বাচনে সাম্প্রতিককালে লেবার দলের বিপুল আসনে জয়লাভ টোরি সমর্থক বিগ মিডিয়ার দাপট শুধু চূর্ণ করেনি, ব্রিটিশ রাজনীতিতে চরম বামপন্থি বলে নিন্দিত জেরেমি করবিনের নেতৃত্বটিকেও পাকা করে দিয়েছে। অন্যদিকে করবিন ১৯৮৩ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে লেবার পার্টির বড় পরাজয়ের মধ্যেও বিশেষভাবে নজর কেড়েছিলেন দলটির তরুণ এক নেতা। দলের ডাকসাইটে নেতারা যেখানে পরাজিত হয়েছেন, সেখানে তিনি সবাইকে চমকে দিয়ে হয়েছেন এমপি। সে সময়ের নজরকাড়া এই তরুণই আজকের লেবার পার্টির প্রধান জেরেমি করবিন। ওই নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে নিজের নেতৃত্ব গুণের প্রমাণ দিয়ে পৌঁছে গেছেন দলের শীর্ষ পদে। স্পষ্টবাদী ও প্রথাবিরোধী হিসেবে পরিচিত করবিন দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দুই বছরের মধ্যেই মোকাবিলা করেছেন নির্বাচনী চ্যালেঞ্জের। ব্যতিক্রমী মানসিকতা ও কর্মপন্থার কারণে দলের ভেতরেও অনেকে তার বিরোধিতা করেন প্রকাশ্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন করবিনের চিন্তাচেতনার সফলতা। নির্বাচনী ফলাফলে যার সবটা ফুটে ওঠে না। লেবার পার্টি নির্বাচনে হেরে গেলেও এই নেতা যে ব্রিটেনে রাজনীতিতে নতুন কিছু করবেন তার আভাস পাওয়া গেছে এবারই। তরুণ ও মধ্যবিত্ত কর্মজীবী সমাজ একচেটিয়া সমর্থন দিয়েছে তাকে। তার দূরদর্শী প্রচারণা পদ্ধতি খুবই প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে। করবিন এমন একজন নেতা যিনি প্রকাশ্যে বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার জন্য পররাষ্ট্রনীতিকে দায়ী করেছেন। বরাবরই বিদেশে যুদ্ধে জড়ানোর বিরুদ্ধে কথা বলা এই নেতা নিজেদের দুর্বলতা লুকাতে পছন্দ করেন না। যে কারণেই হয়তো প্রয়োজনে চরমপন্থী গ্রুপগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন রক্ষণশীল রাজনীতিকদের কাছে।

অপরদিকে নির্বাচনের আগে কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার কারণে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এসব ঘটনাকে পুঁজি করে নির্বাচনী ফায়দা তুলতে চেষ্টা করেছেন। বিপরীতে করবিন তার অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির বাণী প্রচার করে মন জয় করেছেন ভোটাদের। রক্ষণশীল নেত্রী থেরেসা মে সন্ত্রাসী হামলার যতটা ফলাফল ঘরে তুলবেন বলে আশা করেছিলেন তা হয়নি হয়তো করবিনের প্রতি মানুষের আস্থার কারণে। ব্রিটেনের এ সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। আসন সংখ্যা আগের চেয়ে ১২টি কমে ৩১৮তে নেমে গেছে। এর মধ্যে থেরেসা মে সরকারের আটজন মন্ত্রীও রয়েছেন। জোট সরকার গঠনের প্রাক্কালে তাদের পরাজয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছেন মে। নিয়ম অনুযায়ী, এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে কোনো দলকে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৩২৬টি আসনে জয় পেতে হয়। এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ৩১৮টি আসন। তাই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টিকে (ডিইউপি) নিয়ে জোট সরকার গড়ছেন থেরেসা মে।

অনেক দিন পর লেবার পার্টি এমন একজন নেতা পেল, যিনি তার ব্যক্তিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক দিন দলকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। তিনি ‘নতুন এক লেবার পার্টির’ জন্ম দিতে যাচ্ছেন, যেখানে পুরনো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির ধারণা আবার ফিরে এসেছে। নয়া সরকারের জন্য দুটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসন নীতিতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা এবং ব্রেক্সিট আলোচনায় ব্রিটেনের শক্ত অবস্থানে যাওয়া। এমনকি সন্ত্রাসী কর্মকা- নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। ধারণা করা হয়েছিল, ম্যানচেস্টার ও লন্ডন ব্রিজে সন্ত্রাসী হামলার পর মানুষ কনজারভেটিভদের আরো বেশি করে ভোট দেবে, যাতে কনজারভেটিভরা তথাকথিত ‘জঙ্গি কার্যক্রম’ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে পারে। থেরেসা মে এটাকে ইস্যু করতে চেষ্টা করেছিলেন। তার ধারণা ছিল, তিনি জঙ্গিদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিলে মানুষ তার দলকে আবার ক্ষমতায় বসাবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। কিন্তু থেরেসা মে নির্বাচনের আগে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট করেছিলেন। এক. সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় মানবাধিকার আইনে তিনি পরিবর্তন আনবেন; দুই. বিদেশি সন্ত্রাসী সন্দেহভাজনদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাবেন; তিন. হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের চলাফেরায় তিনি নিয়ন্ত্রণ আনবেন। কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা গেল মানুষ তার কথায় আস্থা রাখতে পারেনি। থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। অভিযোগ আছে ম্যানচেস্টারে সন্ত্রাসী হামলায় (অ্যারিয়ানা গ্রানডের কনসার্টে) জড়িত ছিলেন সালমান আবেদি। তার গতিবিধি সম্পর্কে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ধারণা ছিল। লিবিয়ার একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। থেরেসা মে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন আবেদি ও তার সমর্থকরা একাধিকবার ব্রিটেন থেকে লিবিয়ায় গেছে। গোয়েন্দারা তার তৎপরতা সম্পর্কে অবগত ছিল। আর সে কারণেই থেরেসা মের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি।

এই নির্বাচনে তাই বলা চলে, কোনো দলের জয়-পরাজয় নয়; এটা বিশ্বব্যাপী ধনবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জনগণের প্রাথমিক বিজয়। বিশেষ করে বিগ মিডিয়ায় পরাজয়। মনে হয়, যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী কায়েমি স্বার্থের স্বার্থ ও আধিপত্য শুধু অপপ্রচারের সাহায্যে টিকিয়ে রাখার জন্য এক শ্রেণির বিগ মিডিয়া যে চেষ্টা চালিয়ে এসেছে, এবারের ব্রিটিশ নির্বাচনে তার অবসান সূচিত হয়েছে। এই বিগ মিডিয়ার ভূমিকা এখন ভালোভাবে এক্সপোজড হচ্ছে। তাই ভারতে মোদি সরকার, আমেরিকায় ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিশ্বের সর্বত্র গণবিরোধী ব্যক্তি ও শক্তির ক্রমাগত ক্ষমতা দখলের যে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছিল, ফ্রান্সে বর্ণবাদী লে পেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তা প্রতিহত হয়। এখন ব্রিটেনেও বিগ মিডিয়া ও এলিট ক্লাসের প্রচার-প্রচারণা ব্যর্থ করে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম আবার প্রতিরোধের শক্তিতে উজ্জীবিত হয়েছে। ক্ষুব্ধ তারুণ্য দলবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ রাজনীতির ধারা বদলাতে চলেছে। এটাই এবারের ব্রিটিশ নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য। গত এপ্রিলে আগাম নির্বাচন আহ্বান করার সময় থেরেসা মের ধারণা ছিল জনগণ তাকে আগের কনজারভেটিভ নেতাদের চেয়ে বেশি সমর্থন দেবে। এই প্রত্যাশার পেছনে মূল কারণ ছিল তিনটি ব্রেক্সিট আলোচনা শুরু, বিরোধী দল লেবার পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও জনমত জরিপে বিরোধী নেতার চেয়ে এগিয়ে থাকা। আর এগুলোর ওপর ভরসা করেই তিনি ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ না করে পার্লামেন্টে নিজেদের অবস্থান জোরদার এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আরো পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন। ব্রেক্সিট ছিল মধ্যবিত্ত কর্মজীবী ব্রিটিশদের আন্তরিক চাওয়া, যে লক্ষ্যে তারা গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত করেছে। থেরেসা ভেবেছিলেন এ কারণেই মধ্যবিত্ত ব্রিটিশরা তার দলকে ভোট দেবে। যদিও তা হয়নি। যতগুলো আসন নিয়ে থেরেসা নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন ততগুলো আসনও পায়নি তার দল (১২টি আসন কমেছে)। জার্মানির আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে নির্বাচন নিয়ে তাদের মূল্যায়নে বলেছে, ‘থেরেসার বিশ্বাস ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্ব নিশ্চিত করতে পারবেন। কিন্তু তা তো হলোই না, বরং আরো বেশি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হয়েছে তাকে। এছাড়া নির্বাচনের পর দলের মধ্যেই বিরোধিতা শুরু হয়েছে তার। এমনকি পদত্যাগের দাবিও উঠেছে। শেষ পর্যন্ত কী হয় এটাই দেখার বিষয়।

লেখক : কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য প্রবাসী

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
থেরেসা মে,ওভার,কনফিডেন্স
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist