মাহবুবুল আলম

  ২৭ মে, ২০১৭

প্রযুক্তি

ইভিএম : বিএনপির আতঙ্ক কেন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে, দিন দিন তা স্পষ্ট হচ্ছে। শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে মুখে যত কথাই বলুক, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা যে যাচ্ছে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি যে ভুল করেছিল সে ভুলের পুনরাবৃত্তি যে তারা আর করতে চায় না, তা অধিকতর স্পষ্ট হয়েছে তাদের ভিশন ২০৩০ ঘোষণার মাধ্যমেই।

২২ মে ২০১৭ নির্বাচন কমিশন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিনার কেএম নূরুল হুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আগামী নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করার জন্য লিখিতভাবে চিঠি দেয় বিএনপি। সিইসি কেএম নূরুল হুদার কাছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এ-সংক্রান্ত চিঠি তুলে দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এই প্রথম তারা ইভিএম নিয়ে লিখিতভাবে কমিশনে আপত্তি জানাল। এর আগেও বেশ কিছু স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণায় বিএনপি আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচনে ডিজিটাল কারচুপি করার জন্যই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের কথা বলছে। একই কথা আবারও বলেছে বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল। প্রধান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এ বিষয়ে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, সিইসিকে বলেছি আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হোক, বিএনপি তা চায় না। দলের মহাসচিবের চিঠি দেওয়ার পর সিইসিকে তারা বলেছেন, বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে ইভিএম পরিত্যাগ করছে, সেখানে বাংলাদেশে এ ধরনের ভোটিং মেশিনের ব্যবহার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গত ১১ মে সিইসি কেএম নূরুল হুদা এক অনুষ্ঠানে জানান, রাজনৈতিক দল ও সরকার চাইলে একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা সম্ভব।

ইভিএমের বিষয়টি বাংলাদেশে একবারে প্রথম নয়। এর আগে ২০০৭ সালে ঢাকার অফিসার্স ক্লাবের কার্যকরী সংসদের নির্বাচনে এ পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করা হয়। এরপর আবার সফলভাবে একই ক্লাবের ২০০৯ সালের নির্বাচনে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ছোট নির্বাচনে সফলতার পর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে এ প্রকল্প জমা দেন উদ্ভাবক, বুয়েটের আইআইসিটি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এস এম লুৎফুল কবির। তখন ছবি সংবলিত ভোটার তালিকার কাজ চলার কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। পরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরীক্ষমূলক কার্যক্রমকে সামনে রেখে ১৩০ ইভিএম তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ১০০টি ইভিএম চট্টগ্রামে আনা হয়। তবে ১৪টি ভোটকেন্দ্রের ৭৯টি বুথে ৭৯টি ও প্রতি কেন্দ্রের জন্য একটি অতিরিক্ত হিসেবে মোট ৯৩টি ইভিএম স্থাপন করা হয়। সে বছর ১৭ জুন অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে সফলতা আসে। সেখানে মোট ২৫ হাজার ২৩৮ জন ভোটার ইভিএমে ভোট প্রদান করেন। ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার নতুন এই পদ্ধতি সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগায়। দ্রুত ভোটগ্রহণ ও ফল ঘোষণায় ইবিএম পদ্ধতির সফল কার্যকারিতার প্রমাণ মেলে। এ নির্বাচনে ভোট গণনার ক্ষেত্রে অন্য ওয়ার্ডগুলোতে যেখানে তিন থেকে দশ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগেছে, এ ক্ষেত্রে জামাল খান ওয়ার্ডে ঘণ্টার মধ্যেই ফল ঘোষণা সম্ভব হয়েছে।

আমাদের দেশের জন্য নতুন হলেও ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি প্রথম চালু হয় যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ সালে। এবং ৪ বছরের মধ্যেই ৭টি রাজ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। আইনগতভাবে আমেরিকা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, কাজাখস্তান, পেরু, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভেনিজুয়েলায় চালু রয়েছে ইভিএম প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোটগ্রহণ পদ্ধতি। যেসব দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম চালু হয়েছে সেব দেশ দুই ধরনের ই-ভোটিং পদ্ধতি ব্যবহার করছে। একটি হচ্ছে রিমোট ই-ভোটিং এবং অপরটি হচ্ছে পোলিং পেস ই-ভোটিং। রিমোট ই-ভোটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে, সেই দেশগুলো হচ্ছেÑ অস্ট্রিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। অপরদিকে পোলিং পেস ই-ভোটিং ব্যবহার করে সেই দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তবে এ কথাও সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গতবারের ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতির ওপর সেখানকার বেশিরভাগ ভোটারের আস্থা বিঘিœত হয়েছে। হ্যাকিং নিয়ে কারচুপির প্রশ্নে যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। শেষ পরিনতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এ মুহূর্তে বলা খুবই কঠিন।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রথম পরীক্ষামূলক ই-ভোটিং সিস্টেম চালু করে ১৯৮২ সালে। কিন্তু ইন্ডিয়ান সুপ্রিমকোর্ট এই পদ্ধতিকে আইনের দোহাই দিয়ে বাতিল করে দেয়। পরবর্তীতে আইনের সংশোধনী এনে ২০০৩ সালে ভারতীয় লোকসভার নির্বাচন ই-ভোটিং পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। আর এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য ৩৫টি প্রদেশে প্রায় ৭,০০,০০০ পোলিং স্টেশন স্থাপন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনেও ব্যবহার করা হয় ইভিএম।

আমেরিকায় ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫০ মিলিয়নের ওপর স্বীকৃত ভোটার পোলিং পেস ই-ভোটিং পদ্ধতিতে ভোট প্রদান করেন। ৫৫ মিলিয়ন ভোটর অপটিক্যাল স্কেন সিস্টেম ব্যবহার করেন। এবং ৩২ মিলিয়ন ভোটার পাঞ্চ কার্ড ব্যবহার করে ভোট প্রদান করেন। তাছাড়া ২০০৭ সালে উবঢ়ধৎঃসবহঃ ড়ভ উবভবহংব ২০০৮ সালে চৎবংরফবহঃরধষ বষবপঃরড়হ ২০১০ সালে সাধারণ নির্বাচন ই-ভোটিং পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। ২০০৭ সালে স্কটল্যান্ডে স্কটিশ সংসদ নির্বাচন এবং স্কটিশ কাউন্সিল ইলেকশন ই-ভোটিং পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। জার্মানিতে ২০০২ সালে ১০,০০,০০০ ভোটার ইভিএম মেশিন ব্যবহার ভোট প্রদান করেন। অস্ট্রেলিয়ায় ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফেডারেল নির্বাচনে স্বাধীনভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করে ইলেকট্রনিক্স পদ্ধতিতে ভোট প্রদান করার জন্য অন্ধ কিংবা যাদের দৃষ্টিশক্তি কম তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।

একটি নির্বাচন কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে থাকে ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিট। এই ইউনিটের সম্মুখভাগে থাকে ডিজিটাল ডিসপ্লে। অন্যদিকে ব্যালট নামক একটি সুইচ। এই সুইচটি চেপে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ভোটারকে ভোট দিতে বুথে পাঠান। এই সুইচটি চাপলে বুথের মধ্যে থাকা ইভিএমের অপর অংশ ব্যালট ইউনিটটি একটি ভোট দেওয়ার জন্য কার্যকর হয়। ভোট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার অকার্যকর হয়ে যায় ব্যালট ইউনিটটি। যতক্ষণ না আবার কন্ট্রোল ইউনিটের ব্যালট সুইচ চাপা হচ্ছে। ভোট দান শেষে ভোটার বেরিয়ে গেলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার আবার ব্যালট সুইচ চেপে ব্যালট ইউনিটটি কার্যকর করেন।

কন্ট্রোল ইউনিটে আরো কিছু সুইচ আছে। ভোট শুরু করার জন্য স্টার্ট সুইচটি চাপতে হয়। মেশিনে আগে থেকে কোনো ভোট জমা থাকলে স্টার্ট সুইচ চাপলেও মেশিন চালু হবে না। পরীক্ষামূলক কোনো ভোট নেওয়া হলে কেবল তা মুছে ফেলার পরই আসল ভোটগ্রহণ কার্যক্রম শুরু করা যাবে। স্টার্ট সুইচ চেপে ভোটগ্রহণ একবার শুরু হলে আর ভোট মোছার কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। পরীক্ষামূলক ভোট মোছার জন্য যে সুইচটি রয়েছে তা স্টার্ট সুইচ চাপার পর অকার্যকর হয়ে যাবে। স্টার্ট সুইচের পাশেই আছে ক্লোজ সুইচ। এই সুইচটি চাপলেই ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। কেন্দ্রে কোনো ধরনের হামলা বা আঘাত এলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ক্লোজ সুইচটি চেপে দিতে পারেন। পুরো মেশিনের প্রোগ্রাম পরিবর্তন না করা হলে এরপর শুধু ফল দেখা ছাড়া এটি আর কোনো কাজে লাগবে না। প্রোগ্রাম পরিবর্তন কঠিন প্রযুক্তিক এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই এই নিয়ে অহেতুক সংশয় সৃষ্টি না করে আধুনিক ভোটদান পদ্ধতিতে বাংলাদেশকে যুক্ত করাটাই হবে সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত।

পরিশেষে বলতে চাই, যদি সত্যি সত্যি আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হয়, তবে ইভিএম চালু করার আগে সাধারণ জনগণকে এই পদ্ধতিতে ভোট প্রদান সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ যেন ভোট দিতে পারে, সেই ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। ইভিএম সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করার জন্য সব সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। তবেই সব বিভ্রান্তির অবসান হয়ে ইভিএমে ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে আমরাও উদাহরণ হতে পারব।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইভিএম,বিএনপি,আতঙ্ক
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist