দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ২৪ মে, ২০১৭

বাল্যবিবাহের অভিশাপ

বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে কিছুতেই রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ঘটছে না বাল্যবিবাহের ঘটনা। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরগুনা জেলার পাথরঘাটায় সাড়ে চার মাসে ২৪টি বাল্যবিবাহের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। প্রকৃত চিত্র যে আরো বেশি তা সহজে অনুমেয়। বাল্যবিবাহ রোধ আইনে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাল্যবিবাহের বিধান রাখায় প্রকারান্তরে এ অন্যায়কে উৎসাহিত করা হয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে উপজেলা পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও জনসচেতনতার অভাবে তা কোনো সুফল বয়ে আনতে পারছে না।

পাথরঘাটায় বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নিয়োজিত একটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ জেলায় ২০১২ সালে বাল্যবিবাহ হয়েছিল ৯০টি। পরের বছর ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬৮টি। ২০১৪ সালে তা আরো কমে ৫৯ এবং ২০১৫ সালে ৪৬টি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে। গত বছর বাল্যবিবাহের সংখ্যা ছিল ৩৬টি। চলতি বছরের সাড়ে চার মাসে ২৪টি বাল্যবিবাহ হওয়ায় বছর শেষে তা গত কয়েক বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাল্যবিবাহ রোধে যেমন আইনগত সুরক্ষা প্রয়োজন, তেমনি দরকার সামাজিক সচেতনতা। দেশে আগে থেকেই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন থাকা সত্ত্বেও তা অগ্রাহ্য করা হয়েছে ঢালাওভাবে। চলতি বছর এ সংক্রান্ত আইনে বিশেষ ব্যবস্থায় বাল্যবিবাহের সুযোগ রাখায় তা আইন ভঙ্গকারীদের উৎসাহ জোগাচ্ছে।

বাল্যবিবাহ রোধে ১৮ বছরের নিচে নারীদের বিবাহের ঘটনাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি যেসব কারণে অভিভাবকরা তাদের কন্যাসন্তানকে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হন, সেগুলোর দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। ইভ টিজিং বা নারীকে উত্ত্যক্ত করার যে ভয়াবহ প্রবণতা সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তার হাত থেকে কন্যাশিশুকে বাঁচাতে অভিভাবকরা জেনেশুনেই বাল্যবিবাহে তাদের বাধ্য করেন। বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে বখাটেপনার বিরুদ্ধে সরকার ও সমাজকে কঠোর হতে হবে। এ ধরনের অপরাধ করে কেউ যাতে পার না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সমাজ আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন। এমনকি এখন বাল্যবিবাহের ঝুঁকির ভেতর রয়েছে এমন অল্পবয়সী মেয়ে নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে দিচ্ছে সমাজে এর দৃষ্টান্তও তৈরি হয়েছে। তারপরও দেশ থেকে এই ব্যাধি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।

জরিপ অনুযায়ী বাল্যবিবাহপ্রবণ ১০ জেলা হচ্ছে বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, কুষ্টিয়া ও খুলনা। জরিপে দেখা যাচ্ছে, যেসব এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার কম, সেখানে বাল্যবিবাহের হার বেশি। বাল্যবিবাহপ্রবণ এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার ১৫ দশমিক ৯ থেকে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত। জন্মসনদ থাকলে কাজী, আইনজীবী সবাই বিয়ে পড়ানোয় দ্বিধা করেন না। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন অসচেতন অভিভাবকরা। এ ধরনের সমস্যায় বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে প্রাথমিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুয়া জন্মসনদ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া নোটারি পাবলিক বিয়ের হলফনামা না দিলেও বাল্যবিবাহ কমে আসবে।

বাংলাদেশের সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের জন্য বিয়ের আইনি বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর। ১৮ ও ২১ বছর বয়সের নিচে কোনো মেয়ে ও ছেলের মধ্যে বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ হিসেবে পরিগণিত হয়। পরিসংখ্যান বলছে, ১৮ বছরের নিচে কন্যাসন্তানের বেশি বিয়ে হয়, এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ৬৪ শতাংশ শিশুর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। মেয়েদের বিয়ের বয়স হিসেবে ১৮ বছরকে একটা স্ট্যান্ডার্ড ধরে নেওয়া হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশে। যেমন ইংল্যান্ডে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮, আমেরিকায় ১৮, ফ্রান্স-জার্মানি-ইতালি-স্পেনে ১৮ বছর। এমনকি সার্কভুক্ত দেশ ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কায়ও ১৮ বছর। লক্ষণীয় চীন-জাপানে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ২০, মালয়েশিয়ায় একুশ। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ষোলো।

নারী পাচার, মাদক ব্যবসা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়—এ সবই দায়ী বাল্যবিবাহের জন্য। তবে গ্রামবাংলায় মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বাল্যবিবাহের হার কমে আসবে বলে ধারণা করা যায়। এজন্য সামাজিক সচেতনতা জরুরি।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাল্যবিবাহ,নারী নির্যাতন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist