মিয়া মো. শামীম

  ২১ মে, ২০১৭

এ কান্নার শেষ কোথায়

শিশুরা সুন্দর। শুধু মানব শিশুই নয়। প্রাণী অথবা জীবজগতের যেকোনো শিশুই পৃথিবীর সেরা সুন্দরের একটি। আর এই বিশাল শিশু জগতের মাঝে মানব শিশুদের ভেতরে পাওয়া যায় এক বিশেষ জ্ঞানের সমাহার, যা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। আর এই মানব শিশুরাই হচ্ছে সভ্যতা এবং আগামী পৃথিবীর অন্যতম কারিগর। এদের মাঝেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এবং ভবিষ্যৎ।

তবে বহুকাল থেকে পৃথিবীজুড়ে এসব শিশুর একটি বৃহৎ অংশ যেন নিদারুণ অবহেলার শিকার। এখানে পরাধীন শিশুরা যেন এখনো কাঁদছে। অন্নহীন, বস্ত্রহীন, বসতহীন, শিক্ষাহীন, চিকিৎসাহীন, পিতৃ-মাতৃহীন এসব শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই অবহেলা, অনাদর, বঞ্চনা, লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে ধাপে ধাপে। বাবার কোলে অপার স্নেহ, মায়ের শাড়ির আঁচলে মুখ লুকানো স্বর্গীয় সুখ তাদের কপালে জোটেনি। দারিদ্র্যের তলানিতে এদের বসবাস। একশ্রেণির মানুষের এক প্রকার নির্দয় খেলার ফসল এসব শিশু। মানব গোত্রের বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এসব শিশুকে। আর সে কারণেই এরা আজ মানব শিশুতে নেই। মানব শিশু থেকে পরিণত হয়েছে পথশিশুতে। অথচ আমরাই বলে থাকি, আজকের শিশুরা আগামী দিনের কর্ণধার, দেশ ও জাতির সোনালি ভবিষ্যৎ। এক দিন এরাই দেশের পরিচালক হবে!

এদের বেড়ে ওঠার ওপরই যদি রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমাজ ও পরিবারের সুখ, শান্তি, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারা নির্ভর করে, তাহলে কেন বই-খাতার পাতা গুটিয়ে শৈশবেই এই অধিকার থেকে বঞ্চিত শিশুগুলো চালিয়ে যাচ্ছে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ? বিশেষ করে ব্যস্ত শহরে ময়লার ব্যাগ কাঁধে তাদের ছুটতে হচ্ছে বাসটার্মিনাল থেকে রেলস্টেশনসহ অলিতেগলিতে। কাগজ কুড়ানো কিংবা ভিক্ষা করে কেন চালাতে হবে তাদের জীবন। রাষ্ট্র ও সমাজের অবহেলা মানুষের ধিক্কার এমনকি শারীরিক নির্যাতনও সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়তই এসব পথশিশুকে।

২০০৫ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ৫১ শিশু মানসিক নির্যাতনের এবং ২০ শতাংশ শিশু শারীরিক র্নিযাতনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। যৌন নির্যাতনের শিকার ৪৬ শতাংশ নারী শিশু, সার্বিকভাবে ১৪.৫ শতাংশ শিশু নানানভাবে র্নিযাতনের শিকার। এই শিশুগুলো অনেক সময় ক্ষুধার জ্বালায় বিভিন্ন হোটেলের বাসি-পচা খাবার এমনকি ডাস্টবিনে ফেলা ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবারও খেয়ে থাকে। নোংরা স্থানে চলাফেরা ও ঘুমানোর কারণে অধিকারবঞ্চিত প্রায় ১০ লাখ পথশিশু মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। অপর এক জরিপে বলা হয়, প্রায় ৪০ ভাগ পথশিশু প্রতিদিন গোসল করতে পারে না, আর ৩৫ ভাগ শিশু খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে। রাতে ঘুমানোর জন্য ৪১ ভাগ শিশুর কোনো বিছানা নেই। সমাজে ওদের কোনো মূল্য নেই।

আর সে কারণেই পথশিশুদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্বলতার সুযোগকে ব্যবহার করে কিছু অপরাধী চক্র। এদের মাদক বহনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করার সুযোগ পায় এবং করে থাকে। এক সময় এরা মাদকবহন বা একাধিক কারণে নিজেরাই আসক্ত হয়। তথ্যমতে, প্রায় ৮৫ ভাগ পথশিশু কোনো না কোনো মাদকে আসক্ত । ঢাকা বিভাগের মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে আর ১৭ শতাংশ মেয়ে শিশু। তাদের বয়স ১০ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে একটি উন্নয়নশীল ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে পরিণত হতে চলেছে। দেশের শিক্ষা, কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প, বাণিজ্য, মাথাপিছু আয়, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নাগরিক সুবিধা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও আমরা পথশিশুদের বেলায় তেমন এগোতে পারিনি।

এটা সত্য যে, দেশের সরকার শিশুশ্রম রোধে কাজ করে যাচ্ছে বা বিভিন্নভাবে শিশুদের রক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। শতকরা ৮৫ ভাগ শিশু সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা পায় না। শিশুদের জন্য সরকার প্রতিবছর যে অর্থ বরাদ্দ করে তা যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দেশে পথশিশুদের সংখ্যা বহুলাংশে কমে আসত বলে মনে করেন সমাজ বিশ্লেষকরা। পথশিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সমাজ অন্তরায় হওয়ায় যেকোনো মুহূর্তে তাদের ওপর দুর্ঘটনা নেমে আসতে পারে। বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়।

সম্প্রতি যৌন নির্যাতনবিরোধী নীতিমালা বেশ আলোচনা হলেও মেয়ে পথশিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছে, এমনটা মনে হওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। পথেঘাটে রাত যাপনের ফলে, তারা নানানভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও সংশ্লিষ্টদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা মনে করি, মাথাব্যথা থাকাটাই জরুরি হতে হবে। পথশিশুদের মানব শিশুতে রূপান্তর ঘটাতে হবে। দেশের নাগরিক হিসেবে অন্য শিশুদের মতো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার তাদেরও আছে। আশা করি, রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সমাজ,পথশিশু,শিশু
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist