যুবায়ের আহমাদ

  ১৮ মে, ২০১৭

পর্যালোচনা

কর্মক্ষমতা ও কওমি শিক্ষা

রেজওয়ানুর রহমান খান। একজন সফল ব্যাংকার। ১৯৯৯ সালে শুধু কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস পাসের ভিত্তিতে তিনি আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে অফিসার পদে যোগদান করেন। কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে একের পর এক পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তিনি ব্যাংকের ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট।

মুফতি নাসির উদ্দিন। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ ছোবহানিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রভাষক (আরবি)। ছাত্রজীবনের এক দিনও তিনি কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়/আলিয়া মাদরাসার ক্লাসে বসেননি। কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়ার (কওমি মাদরাসা) নিয়মিত দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। এক দিনও আলিয়া মাদরাসায় ক্লাস না করে কওমিতে পড়ে আলিয়া মাদরাসায় শুধু পরীক্ষা দিয়ে দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল সবগুলোতেই প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে করিমগঞ্জ ছোবহানিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রভাষক (আরবি) পদে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।

ব্রিটিশ পূর্ব ভারতে মাদরাসার ব্যয়ভার বহনের জন্য বিপুল সম্পত্তি ওয়াকফ ছিল। ব্রিটিশরা মাদরাসা বন্ধ করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দেওয়ার পর দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। যেহেতু দেওবন্দ ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু তাই দেওবন্দকে ব্রিটিশরা স্বীকৃতি দেবে তা কল্পনাতীত। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়াই এ ধারায় শিক্ষিতরা গণমানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না থাকায় অনেক দক্ষ ও মেধাবীরাও জাতির কল্যাণে কাজ করতে পারছিলেন না। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী এ ধারায় শিক্ষিত জনশক্তিকে গণমানুষের কল্যাণে আরো বেশি কাজে লাগাতে এর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে আরবি/ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্সের সমমান প্রদানের পর অনেকেই কওমি শিক্ষিতদের যোগ্যতা, কর্মক্ষমতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছেন।

আসলেই কি এরা ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স পাসদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো যোগ্যতা রাখে না? প্রতিটি কলেজ ও আলিয়া মাদরাসায় আরবি/ইসলামী শিক্ষা বিষয়ে প্রভাষকের পদ আছে। এ পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা হলো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি/ইসলামী শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক অথবা মাদরাসা থেকে কামিল ডিগ্রি। বাংলাদেশে অনেক আলিয়া মাদরাসা/কলেজে ইসলামী শিক্ষার এমন প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পাওয়া যাবে, যারা আলিয়া মাদরাসা থেকে শুধু দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল পরীক্ষা দিয়ে সনদ নিয়েছেন, কিন্তু একদিনও আলিয়াতে পড়েননি। তাদের মূল লেখাপড়া হয়েছে কওমি মাদরাসায়। তা সত্ত্বেও এসব পরীক্ষাতেই প্রথম বিভাগ এমনকি বোর্ডের মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। যাদের প্রায় সবাই শিক্ষার্থীদের কাছেও তারা বেশি প্রিয় কারণ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাত্রদের বোঝানোর ক্ষেত্রেও তারা অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

যোগ্যতাটা তৈরি হয় কওমি মাদরাসাতেই। কিন্তু যোগ্যতা থাকলেও তা সরকার স্বীকৃত ছিল না। এর স্বীকৃতি নিতে হতো আলিয়া থেকে। আর এ ঝামেলার জন্য অনেক মেধাবীই চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারত না। ফলে জাতি তাদের মানসম্পন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হতো। বর্তমান সরকার যা করেছে তাতে আর এ মেধাবী শিক্ষার্থীদের শুধু স্বীকৃতির জন্য আলিয়ায় পরীক্ষা দেওয়ার বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হবে না। সরাসরি তারা চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। ফলে মেধাবীদের সেসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়বে, বাড়বে প্রতিযোগিতা। দুর্বলরা ছিটকে পড়বে সে প্রতিযোগিতা থেকে। সেবার এ খাতগুলো আরো মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্য লোক পাবে।

প্রশ্ন হলো অফিস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের কাজ কি পারবে কওমি মাদরাসা শিক্ষিতরা? আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক শুধু দাওরায়ে হাদিস পাসের ভিত্তিতে ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে দুই ধাপে ৯২ জনকে অফিসার পদে নিয়োগ দেয়। ৯২ জনের সবাই কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখে। এদের থেকে অনেকেই বর্তমানে বিভিন্ন শাখার ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার), কয়েকজন প্রিন্সিপাল অফিসার এবং কয়েকজন জ্যেষ্ঠ মুখ্য কর্মকর্তার মতো শীর্ষ প্রশাসনিক পদে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ৯২ জনের মধ্যে থেকে কয়েকজন আল আরাফা ব্যাংকের অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্যান্য ব্যাংকে শীর্ষ পদে কর্মরত আছেন।

কওমিতে পড়ে জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিজাইনার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়েছেন অনেকে। কওমি থেকে লেখাপড়া করে আলিয়া থেকে শুধু সনদ নিয়ে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন বিপুল সংখ্যক লোক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ডজন শিক্ষক আছেন, যাদের শেকড় কওমিতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হিফজুল কোরান ও ক্বিরাতের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অর্ধশত দেশকে পেছনে ফেলে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে পৃথিবীবাসীর কাছে উজ্জ্বল করে তুলে ধরার কৃতিত্ব কিন্তু কওমি মাদরাসা পড়ুয়াদেরই। ক’দিন পরপর তারাই এ গৌরব বয়ে আনছে বাংলাদেশের জন্য।


যোগ্যতা তৈরি হয় কওমি মাদরাসাতেও। কিন্তু যোগ্যতা থাকলেও সরকার স্বীকৃত ছিল না। এ কারণে অনেক মেধাবীই চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারত না। বর্তমান সরকার যা করেছে তাতে আর এ মেধাবী শিক্ষার্থীদের শুধু স্বীকৃতির জন্য আলিয়ায় পরীক্ষা দেয়ার বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হবে না। সরাসরি তারা চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে


কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, ‘কওমি শিক্ষিতরা কি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ পারবে?’ এর যথাযথ উত্তরের জন্য প্রশ্নকারীকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, যে ছাত্রটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে সে কি ইঞ্জিনিয়ারিং পারবে? নিশ্চয়ই তিনি উত্তরে বলবেন, ‘তার বিষয় তো ইতিহাস, তিনি কেন ইঞ্জিনিয়ারিং। সে কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পারবে?’

তিনি যেমন উত্তরে বললেন, ‘তার বিষয় তো ইতিহাস’ তেমনি তার প্রশ্নের উত্তরও তাই। যে ছাত্রটি কওমি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করেছে তার বিষয়ও তো ইসলামী শিক্ষা। তাকে কেন আপনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতিযোগিতায় নিতে চান? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা একজন লোকের সঙ্গে ইসলামী বিষয়ে তাকে প্রতিযোগিতায় লাগিয়ে দেখুন। আশা করি তিনি হেরে যাবেন না। আর কওমি সনদের স্বীকৃতিটা কিন্তু এই ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়েই দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা কম্পিউটার সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সমমান দেওয়া হয়নি। দেখতে হবে ইসলামিক স্টাডিজে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্নকারী একজন লোকের সঙ্গে প্রথম বিভাগে দাওরায়ে হাদিস পাস করা লোকটি প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম কি না। যিনি একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে দাওরায়ে হাদিসের ছাত্রকে তুলনা করেন, তিনি কিন্তু একবারও এটা চিন্তা করেন না যে, ইঞ্জিনিয়ার কি দাওরায়ে হাদিসের ছাত্রটির সঙ্গে ইসলামী বিষয়ে প্রতিযোগিতা করতে পারবে?

অনেকের অভিযোগ, কওমি মাদরাসা বেকারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আসলেই কি তাই? ০৩ মার্চ ২০১৪ একটি বহুল প্রচলিত দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় ছিল ‘শিক্ষার নামে বেকার তৈরি’। এতে কিন্তু কওমি মাদরাসার কথা বলা হয়নি। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার নামে বেকার তৈরি করে তাই বলেছেন। একই বছরের ২৯ আগস্ট একই দৈনিকের উপসম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘শিক্ষা না বেকার তৈরির কারখানা’। ভেবেছিলাম লেখক কওমি মাদরাসা নিয়ে লিখেছেন। পড়ে দেখলাম, না। তিনি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাকে বেকার তৈরির কারখানা বলেছেন। আসলে বাস্তবতা কী? বেকারত্ব বর্তমান শিক্ষিত যুবকদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেও বেকার থাকতে হচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। ঢাবির ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের দর্শন বিভাগের ছাত্র তারেক আজিজ লেখাপড়া শেষ করে চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করেন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরের সারির বিভাগ ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেও চাকরি না পেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন আবদুল মোমিন তালুকদার। ঢাবির প্রক্টর অফিসের তথ্যমতে, ২০০৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৪ জন ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। আজ পর্যন্ত এমন একটি দৃষ্টান্তও নেই যে কওমি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করে চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, বেকারদের মধ্যে চিকিৎসক প্রকৌশলীর হার ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। কওমি মাদরাসায় সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পড়েও বেকার আছেন এমন লোকের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়। অল্প বেতনে চাকরি করলেও তা দিয়েই তারা পরিবারের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করেন। কওমি মাদরাসার ছাত্ররা কাজের অযোগ্য নন। কওমি মাদরাসাগুলোতে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সমাজ-বিজ্ঞান আছে। স্নাতক পর্যন্ত আছে ইতিহাস ও অর্থনীতি। কওমির বর্তমান সিলেবাসে থাকা বংলা-ইংরেজির গুরুত্ব আরেকটু বাড়িয়ে সিলেবাসের মৌলিক বিষয়গুলো ঠিক রেখে কম্পিউটারের মতো একান্ত প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় সংযোজন করলে এ ধারায় শিক্ষিত, কঠোর অধ্যবসায়ী ও মেধাবী জনশক্তি দেশ-জাতির কল্যাণে আরো বেশি কাজ করতে পারবে।

লেখক : কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কওমি শিক্ষা,শিক্ষা,যুবায়ের আহমাদ,কওমি মাদরাসা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist