বাহালুল মজনুন চুন্নু
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
দিনটি ছিল ১৭ মে ১৯৮১। শেখ হাসিনা ফিরে এলেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। দেশের ভাগ্যাকাশে তখন দুর্যোগের ঘনঘটা, ক্যু-হত্যা যেন নৈমিত্তিক ঘটনা, জাতি নেতৃত্বশূন্য ও লক্ষ্যভ্রষ্ট—‘তখনই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’। নেতা আসবেন, তাই স্বাগত জানানোর জন্য এক মাস আগে থেকেই প্রস্তুত বাংলাদেশ। বিমানবন্দর এলাকা লোকে-লোকারণ্য। গণতন্ত্রের মুখোশধারী স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু আর অপপ্রচারকে উপেক্ষা করে জনতা সেদিন ছুটে এসেছিল প্রাণের নেতাকে শুভেচ্ছা জানাতে। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত এয়ারপোর্টের বিষণ্ন দুপুর।
আকাশ ছিল মেঘলা। নেত্রীকে এক নজর দেখার জন্য সবাই রানওয়ের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছিল। নিরাপত্তা বাহিনীকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল। আমরা রানওয়ের ভেতরে ছিলাম। নেতাকে বয়ে আনা বিমান যে অবতরণ করবে সে জায়গাও ছিল না। সেদিন আমরা জনতাকে বহু কষ্টে সরিয়ে বিমান অবতরণের জায়গা করে দিয়েছিলাম। জাতির পিতার রক্তে ভেজা মাটিতে বিমান স্পর্শ করার খানিক পরেই আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি। বাংলার আকাশ বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় তনয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খুশিতে আবেগে অঝোরে কেঁদেছিল সেদিন। নেত্রীকে বহনকারী বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে জনতার মিছিল যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। এর কিছুক্ষণ পর বিমানের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পুষ্পার্ঘ্যে শোভিত বঙ্গবন্ধুর কন্যা জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিবাদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দ-বেদনায় কান্নার রোল ওঠে সমগ্র বিমানবন্দর এলাকায়। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ স্লোগানের মাধ্যমে নেত্রীকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হচ্ছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম-পিতৃ হত্যার বদলা নেব’ স্লোগানটি। মানুষের সেই তীব্র ভালোবাসা দেখে শেখ হাসিনা নিজেও কান্না ধরে রাখতে পারেননি। সেদিন তিনি পিতা-মাতা, ভাই-বোনসহ স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে শেরেবাংলা নগরের সমাবেশে বলেছিলেন, ‘বাংলার জনগণের পাশে থাকার জন্য আমি এসেছি, মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আমি এসেছি—আমি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আমি আপনাদের বোন হিসেবে, কন্যা হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। ’
দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যখন হত্যা করা হয়েছিল, তখন যদি তার দুই আত্মজা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশে থাকতেন, তবে নরপিশাচদের গুলি তাদেরও বিদ্ধ করত নিঃসন্দেহে। নিঃসন্দেহে ওরা ‘নির্বংশ’ করতে চেয়েছিল জাতির জনকের পুরো পরিবারকে। সৌভাগ্যক্রমে জনকের দুই তনয়া তখন জার্মানিতে ছিলেন, নাহলে মৃত্যু ছিল তাদের জন্যও অবধারিত। ১৫ আগস্টের মাত্র কয়েক দিন আগেই তিনি স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে গিয়েছিলেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে হত্যা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সব ধরনের চেষ্টা করেছিল। জার্মানি দূতাবাস তাকে আশ্রয় দিতে পারেনি বিভিন্ন চাপের মুখে। ওরাই লন্ডনে যোগাযোগ করে নেত্রীকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু লন্ডনেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন দুই বোন। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পরম মমতায় তাদের নিজ দেশে আশ্রয় দেন।
সময়টা ছিল উত্তাল। খুনি সামরিক শাসক চক্র কারাগারের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছিল। রাজনীতিবিদদের বিশেষ আইনে কারান্তরীণ করে রেখেছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অফিসার ও জওয়ানদের ফায়ারিং স্কোয়াডে অথবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হচ্ছিল। বেসামরিক প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধা ও সৎ অফিসারদের কোণঠাসা করে পাকিস্তানিকরণ ও সামরিকীকরণ চলতে থাকে। স্বঘোষিত খুনিরা ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার সহযোগী, আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দুর্দমনীয়। ঐতিহাসিক অ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস ওই সময়ের অবস্থা বর্ণনা করে লেখেন, ‘সে সময় দুর্নীতির মাত্রা দারুণভাবে বেড়ে যায়। জিয়া নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখার মানসে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলেন।’ জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের ইনডেমনিটিই কেবল দেওয়া হয়নি, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ঘাতক-দালালরা কেবল অপরাধ থেকে মাফ পেয়ে যায়নি, রাজনৈতিক দল করার পর্যন্ত অধিকার পেয়েছিল। এক ব্যক্তির স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসনকে আড়াল করার জন্য সেনাশাসক জিয়া সামরিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই সময়। দেশব্যাপী এক অস্থির ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যেন আগ্নেয়গিরির ওপর বসেছিল দেশ। আওয়ামী লীগ ছিল কোণঠাসা, ছত্রভঙ্গ, বহুধা বিভক্ত। এমন পরিস্থিতির মাঝেই ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। আবদুল মালেক উকিল, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আবদুল মান্নান, বেগম সাজেদা চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ডা. এসএ মালেকসহ ডাকসাইটে নেতারা এবং অগণিত কর্মী সমর্থকরা শেখ হাসিনাকে সভাপতি করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। ‘জাতির পিতার রক্ত বইছে যার দেহে, তিনিই পারবেন আওয়ামী লীগকে তার ক্রান্তি দশা থেকে উঠিয়ে অতীত ঐতিহ্যের মতো সমুজ্জ্বল করে তুলে ধরতে’, এমন বিশ্বাস থেকেই নেতাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল।
কিন্তু ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিভীষিকাময় বৈরী পরিবেশে স্বদেশের মাটিতে এসে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ছিল অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু শেখ হাসিনার শরীরে প্রবাহিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি অকুতোভয় দেশপ্রেমিক শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেখ হাসিনার এই পদ গ্রহণে সম্মতি প্রদান করা ছিল এক বিরল সাহসী পদক্ষেপ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি তার চেয়েও বেশি সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে শেখ হাসিনা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেই তিনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন। সেই সময় থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দেশে ফেরার পরদিন থেকেই শেখ হাসিনা একদিকে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও ভাবাদর্শগতভাবে সুসংবদ্ধ করে তোলার লক্ষ্যে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন। বহুধাবিভক্ত ব্র্যাকেটবন্দি আওয়ামী লীগকে জাতীয় মূলধারার প্রধান দল হিসেবে গুছিয়ে তোলা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা সব ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটিকে যুগোপযোগী করে তুলেছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে গিয়ে তাকে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে। শত কোটি প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। তা করেই দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিলেন তিনি। তার সুযোগ্য বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যেতে থাকে দ্রুতগতিতে। ভারতের সঙ্গে ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজে দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে। কিন্তু ২০০১ সালে নির্বাচনী সূক্ষ্ম কারচুপি এবং ষড়যন্ত্রের কারণে পরাজিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দেশের জনগণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে তিন-চতুর্থাংশ ভোটে বিজয়ী করেছিল। এরপর থেকে এ পর্যন্ত তার সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির সোপানে। তারই হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর মধ্যে দিয়ে দেশ দায়মুক্ত, কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছে। তারই বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছার। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বত্রই আজ উন্নয়নের জোয়ার। আজ আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার দ্বারপ্রান্তে তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। তাই তো তিনি আমাদের গর্ব, তিনি আমাদের অহংকার। আজ তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।
লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পিডিএসও/হেলাল