প্রতীক ইজাজ

  ১৩ মে, ২০১৭

বিএনপির ‘ভিশন-২০৩০’

বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থাকে ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি কোথায় নিয়ে যেতে চায়, দলের দেওয়া সেই রূপরেখা ‘ভিশন-২০৩০’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে দেশে। গত বুধবার ঘোষণার পর থেকেই সে রূপরেখা নিয়ে রাজনীতিসহ বিভিন্ন মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশেষ করে এই রূপরেখা বাস্তবায়নকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রূপরেখাকে ‘মেধাহীন ও অন্তঃসারশূন্য’ বলে উড়িয়ে দিলেও বিশ্লেষকরা এর মধ্যে কিছু ইতিবাচক দিকও খুঁজে পেয়েছেন। তারা মনে করছেন, এই রূপরেখার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা ও জ্বালাও পোড়াও রাজনীতির কারণে কিছুটা হলেও কোণঠাসা বিএনপির পুনরায় নিয়মতান্ত্রিক ও নির্বাচনের রাজনীতিতে ফিরে আসার ইঙ্গিত মিলছে। তবে রূপকল্পের কিছু বিষয় নিয়ে বেশ সমালোচনাও রয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা কমিয়ে নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার যে প্রস্তাব, তা ‘শ্রুতিমধুর’ হলেও বাস্তবায়ন সহজ নয় বলে মনে করেন অনেকে। চাকরি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা ও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক কোটা ব্যতীত অন্যান্য কোটা বিলোপের যে প্রস্তাব তা অসাংবিধানিক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে শাসন ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনা, বিচারপতি নিয়োগ, অধস্তন আদালতকে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে আনা, গণভোট প্রবর্তনের মতো ভালো বিষয় রয়েছে বলেও মনে করেন তারা। বিশ্লেষকদের বড় অংশ রূপরেখা বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। বাস্তবায়নে দলের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

গত বুধবার বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে খালেদা জিয়া এই রূপকল্প তুলে ধরেন। দীর্ঘ প্রায় দুই ঘণ্টার বক্তব্যে খালেদা জিয়া ৩৭টি বিষয়ে ২৫৬টি দফা তুলে ধরেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য চাওয়া নিয়ে দফাটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত। এ ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ সব কালাকানুন বাতিল, সংবিধানের পঞ্চদশ ও ষোড়শ সংশোধনীর কয়েকটি ‘অগণতান্ত্রিক’ বিধান সংস্কার, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ছাড়া সব কোটা বাতিল, সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি উৎস বহুমুখী করার লক্ষ্যে ৫০ লাখ টন ক্রুড অয়েল ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন রিফাইনারি নির্মাণ, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পরিচালনার ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত ও ৩৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য। তবে অনেক ক্ষেত্রে কিভাবে বিএনপির এই রূপকল্প বাস্তবায়ন করা হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।

খালেদা জিয়ার এই রূপকল্পকে নির্বাচনী ইশতেহার বলেও মনে করা হচ্ছে। ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর আগে এমন একটি রূপরেখা তুলে ধরার যৌক্তিকতা নিয়ে দলের ভেতর ও বাইরে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে গত সোমবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এই প্রশ্ন তুলেছিলেন কেউ কেউ। গতকাল রুপরেখা নিয়ে কথা হয় দেশের কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের সঙ্গে। তাদের মতে, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে বিএনপিকে। কিছু আশ্বাস পূরণ করতে শুধু সরকার গঠন করলেই হবে না, জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হবে অথবা বিরোধী দলের সমর্থন পেতে হবে। কারণ অনেক প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ফলে এমন একটি রূপরেখা বাস্তবায়ন কতটুকু ও আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে যেমন সংশয় রয়েছে; তেমনি বিএনপিও আসলেই করবে কি না, সেই উপলব্ধিটা এসেছে কি না ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপিকে দলীয় আচরণ ও কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে এসব সংশয় দূর করতে হবে। এমনকি এই রূপকল্প বাস্তবায়নে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন ও রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার বলেও মনে করছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের বর্তমান সার্বিক ও বিএনপির দলীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন একটি ভিশন তুলে ধরা দরকার ছিল। এর মধ্য দিয়ে দুটি কাজ হলোÑ খালেদা জিয়া দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি করতে পারলেন; অন্যটি হলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একটি সুযোগ তৈরি হলো। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে দলকে ক্ষমতায় যেতে হবে। আর ক্ষমতায় যেতে হলে নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তার সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। কর্মসূচি দিয়ে রাখলেই হবে না। তবে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে খালেদা জিয়া সফল।

‘রূপরেখার কিছু বিষয় নিয়ে সংশয় আছে’Ñ উল্লেখ করে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, রূপকল্পে সংসদে দ্বিকক্ষ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এর জন্য ফেডারেল ফরম অব গভর্নমেন্ট, অথবা রিজিওনালিজম, অথবা একটা গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে আসতে পারছে না তাদেরকে আনা। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ করতে হলে প্রশাসন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এগুলো খুবই কঠিন। দেশে সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। সুতরাং, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট কিভাবে করবেন, তা জানি না। এটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। অবশ্য রূপকল্পে তিনি (খালেদা জিয়া) যেসব রাজনৈতিক পরিবর্তন বা সংস্কারের অঙ্গীকার করেছেন, সেগুলো যৌক্তিক। তবে বাস্তবায়নে কোনো সুনির্দিষ্ট কথা বলেননি। ভালো হত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে যদি সুনির্দিষ্ট কিছু বলতেন। সেগুলো কিভাবে ও কতদিনে বাস্তবায়ন করবেন, তা হলে আরো বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যেত। তবে এই রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে হবে। আর ক্ষমতায় যেতে হলে তার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। মাঠে নামতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, খালেদা জিয়া তাদের রূপকল্পে যেসব বিষয় বাস্তবায়নের কথা বলেছেন, সেগুলো আমাদেরও দাবি ছিল। অনেকদিন ধরেই আমরা এসব দাবি জানিয়ে আসছি। এখন বিএনপি সেগুলো করতে চাইছে। এটা ভালো। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, সংবিধানের ৭০ ধারাসহ যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন তা ইতিবাচক। করতে পারলে ভালো। তবে এর জন্য ক্ষমতায় আসতে হবে। আবার কেবল ক্ষমতায় এলেই হবে না, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসতে হবে। আর ক্ষমতায় আসাটা নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ রাজনীতির ওপর। বিএনপির অবস্থা এমনিতেই ভালো না। এ অবস্থা থেকে কতটুকু উৎরাতে পারে, তার ওপর নির্ভর করছে ক্ষমতায় আসা।

‘অতীতে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এখন যেসব সংস্কারের কথা বলছে, তখন সুযোগ ছিল করার। কিন্তু কিছুই করেনি। সুতরাং, এখন করবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেন এম হাফিজউদ্দিন খান।

শাসন ব্যবস্থা ও সংবিধান সংশোধন ছাড়া বিএনপির রূপকল্পের অন্যসব অঙ্গীকার গতানুগতিক বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। ‘ভিশন-২০৩০’ ইতিবাচক বলে মনে করলেও ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি এসব অঙ্গীকার পূরণ করবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, আমার মনে আছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল। অথচ তাদের সরকার ছিল তখনকার সময়ের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার। তাই বিশ্বাসযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের আগে তারা এই অঙ্গীকারগুলো করে যেন অঙ্গীকার ভঙ্গ করার জন্য। এবারও সেই মনোবৃত্তি থেকেই করেছে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন।

এই বিশ্লেষক বলেন, এগুলো তো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো এই কথাগুলো কিন্তু প্রধান দুই দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময় নির্বাচনী ইসতেহারে বলেছে, সবগুলো এখানে পাওয়া যায়। ভাষা হয়তো বদলেছে। যেমন- আওয়ামী লীগ দিন বদলের সনদ দিয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে। এটাও তো অনেকটা দিন বদলের মতোই শোনা যায়। সমস্যা হলো বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। এখন আবার বিএনপি বলছে। কিন্তু কিভাবে করবে, আসলেই করবে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন। আসলেই এই উপলব্ধিটা এসেছে কি না, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে কি না, সেটাও প্রশ্ন।

প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা কমিয়ে সত্যিকারের মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সংসদীয় সরকার প্রবর্তনের যে ইচ্ছে প্রকাশ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানেই প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়। ’৯১ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঐকমত্যেই রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা রদ করে প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়। এখন এটি পরিবর্তন করতে হলে বিএনপি একা পারবে না। সে জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। আর সেটি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ কিছু সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে। তখন বিএনপি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তা প্রত্যাখ্যান করে। এখন আবার বিএনপি সেগুলোই করতে চাইছে। সুতরাং, এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য কি না তা সে সংশয় কিন্তু থেকেই যায়। এমনকি এসব বাস্তবায়নে আন্তরিক কি না, সেটাই প্রশ্ন। এটা কি কেবল বলার জন্য বলা, নাকি উপলব্ধি থেকে বলা, সে প্রশ্ন অন্য অনেকের মতো আমারও। তা ছাড়া দলের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন। কারণ এসব বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে হবে। সে সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। অবশ্য কেবল ক্ষমতায় এলেই হবে না। এটা একদলের পক্ষে সম্ভব না। এর জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। রাজনৈতিক সংস্কার পরিবর্তন দরকার।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাস্তবায়ন,বড়,চ্যালেঞ্জ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist