এস এম মুকুল

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৭

হাওরে দুর্যোগ

যে চোখে জল নেই

প্রথমে বানের জলে ভেসে গেল ধান। সরকারি হিসাবে ক্ষয়ক্ষতি প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। কৃষকের মাথায় চেপে বসল ঋণ এবং সুদের চাপ। দেখা দিল গবাদিপশুর খাদ্য সংকট। যদিও মানুষেরও খাবারের সংস্থান নেই। গবাদিপশু যার যা ছিল কৃষকরা পানির দরে বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করছেন। গরিব যারা, তাদের অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে উজানে আত্মীয়স্বজনের কাছে গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। অপরদিকে হাওর থেকে দলে দলে লোক গ্রাম ছাড়ছে কাজের সন্ধানে। যাদের এখন গোলা থেকে ধান বিক্রি করে আয়েশ করার কথা, সেখানে প্রায় দুই কোটি হাওরবাসী পড়ে গেল সারা বছরের খাদ্য সঙ্কটে। চারপাশে শুধুই দুরাশা-দুর্ভাবনা। এরই মধ্যে হাওরবেষ্টিত এলাকায় চালের দামে আগুন লাগালেন দুষ্কৃতকারী মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা।

এমনটিই ছিল হাওর বিপর্যয়ের প্রাথমিক অবস্থা। কথায় আছে, বিপদ দলবল ছাড়া আসে না। সে রকমটাই ঘটল হাওরবাসীর কপালে। শুরু হলো আরেক দুর্বিপাক! হাওরের পানির নিচে কাঁচা ও আধা পাকা নিমজ্জিত ধান পচে পানি দূষিত হলো। হাওরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল দুর্গন্ধের বিষ। জনগণের বেঁচে থাকাটাই যখন কঠিন, তখন এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ভাগ্য বিপর্যয় ঘটলে বুঝি এমনই হয়। পচা ধানের গন্ধে ও গরমে অ্যামোনিয়া গ্যাসের জন্ম হয় আর পানির অক্সিজেন কমে যায়। ফলে হাওরে শুরু হয় মাছের মড়ক। ধানের পর মাছে বেঁচে থাকার যেটুকু আশায় বুক বেঁধেছিলেন হাওরপারের মানুষগুলো, সে আশাটুকুতেও গুড়েবালি! এখানেই শেষ নয়। বিষাক্রান্ত মরা মাছ খেয়ে মরতে শুরু করল হাঁস। অসহায় কৃষকের এমন দুর্বিপাকের মধ্যেই খাদ্যমন্ত্রী বললেন, ‘হাওরে প্রায় প্রতি বছরই ফসলডুবি হয়। এবার একটু বেশি হয়েছে। তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।’

মন্ত্রী মহোদয় হয়তো সত্য বলেছেন। দেশ অনেক দিক দিয়েই এগিয়েছে। তাই তিনি বুক ফুলিয়ে বলতে পেরেছেন, প্রায় ৩০ লাখ টন ফসলহানির ক্ষতিও তিনি পুষিয়ে নিতে পারবেন! বাংলাদেশ সত্যিই এখন অনেক শক্তিশালী দেশ। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী এও নিশ্চয়ই জানেন, এই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পেছনে হাওরবাসীর অবদান কতটা! হাওরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দুই কোটি মানুষ! তা পোষানো হবে কী দিয়ে? রাতা, টেফি, গচির মতো সুস্বাদু বিরল প্রজাতির দেশীয় ধান এই হাওরেই জন্মে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এখানকার কৃষকরাই তা উৎপাদন করেন। মহাশোল, আইড়, পাবদা, গজালসহ বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির অনেক জাতের মাছ এখনো এই হাওরে পাওয়া যায়। অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, হাওর বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাধারের মধ্যে অন্যতম। সারাদেশের মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে চাষাবাদ ও জীবনযাপন এই হাওরাঞ্চলে এখনো লক্ষ করা যায়। হাওর হচ্ছে বাংলার প্রাকৃতিক মৎস্য খনি এবং আগামী দিনের খাদ্য ভা-ার। বিশ্বখ্যাত রামসার সাইট টাঙ্গুয়া, হাকালুকিসহ এই হাওরাঞ্চলে দেশীয় ও অতিথি পাখির সবচেয়ে নিরাপদ অভয়াশ্রম। হাওরের মাটি ও পানি নিয়ে গবেষণা চলছে, আশা করি ভালো সম্ভাবনার খবর আসবে। হাওরের মাটির নিচে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় হাওরাঞ্চলের অবদান ও ভূমিকা অনবদ্য। এই হাওরাঞ্চলের ফসল ১০ বছর নিরাপদে ঘরে তুলতে পারলে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ থেকে উন্নত ও স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না। জনশ্রুতি আছে, শুধু শনির হাওরের উৎপাদিত ধানে সারা দেশের ছয় দিনের খাদ্য চাহিদা পূরণ হয়।

দেশ ও জাতির কাছে বাংলার কৃষকের পাওনা অনেক। বিশেষত হাওরের কৃষকদের। তাদের শ্রম ও মেধার গুণেই আমাদের দেশের খাদ্যমন্ত্রীদের সফলতা আসে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব যখন বলেন, ‘দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করার মতো তেমন কিছুই হাওরে হয়নি।’ তখন কৃষকের কাছে তা বড় কঠিন বচন মনে হয়! ‘ধান গেছে, মাছ গেছে, হাঁস গেছে, কিন্তু মানুষের জান তো আর যায়নি!’ এই হয়তো ত্রাণ সচিবের বোধ। সম্ভবত এ বোধ ত্রাণ সচিবের একার নয়, ক্যাডার প্রশাসনের। ব্যতিক্রম যে নেই, তাও নয়। কথায় আছে, এক টন দুধ নষ্ট করার জন্য এক ফোঁটা চনাই যথেষ্ট। আমরা জানি না, আর কত দুর্যোগ হলে ত্রাণ সচিবের কাছে মনে হবে- তেমন কিছু হয়েছে? এটাই হাওরবাসীর প্রশ্ন। আর কত ক্ষতি হলে বোধ জাগ্রত হবে? জাগ্রত হোক বা না হোক, এলাকার দাবি একটাই। একটি ‘হাওর মন্ত্রণালয়’ এখন খুব জরুরি। হাওরের বরপুত্র রাষ্ট্রপতি হাওরের দুর্যোগ পরিদর্শন এবং জনপ্রতিনিধি ও কৃষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। আশা করি প্রতিফলন ঘটবে। হাওরের ক্ষতিগ্রস্তরা সুফল ও সুবিচার পাবেন।

মনে রাখতে হবে, হাওরবেষ্টিত ছয় জেলা সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এলাকার অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এক ফসলি বোরো এ জেলার কৃষকদের একমাত্র ভরসা। এই এক ফসলি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন ফসল হারানোর কারণে কৃষকদের ঘরে খাবার নেই। হাতে টাকাকড়িও নেই। কিভাবে তারা বাঁচবেন সে ভাবনায় হাওরবাসীর চোখে ঘুম নেই। হাওরের ধান আর মাছ তো শুধুই হাওরবাসীর নয়, সারা বাংলাদেশের। আগাম বন্যার কবলে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে হাওরের ‘জিরাতিরা’ও। জিরাতিরা হাওরাঞ্চলের বাইরের লোক। যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে আসেন। এক মৌসুমের জন্য জমি ‘পত্তন’ নিয়ে, ঘরবাড়ি বেঁধে, পরিবার-পরিজনসহ এখানে বসবাস করেন। চাষাবাদ থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত। ফসল কাটার পর ফসল নিয়ে কিংবা ফসল বিক্রি করে আবার এলাকায় ফিরে যান তারা। কিন্তু বুক ভরা আশা নিয়ে প্রতিবারের মতো এলেও এবার ফিরে যেতে হচ্ছে খালি হাতে। সর্বজনই জানেন ধান কাটার মৌসুমে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক ধান কাটার জন্য হাওর এলাকায় আসেন। এবার ফসল বিপর্যয়ের কারণে তারাও কর্মহীন। যেটুকু পাওয়ার আশা ছিল কেউই পেল না তা। সরকারি হিসাবে হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩শ’ কৃষক-পরিবারের মোট ক্ষতি ৩২৮৮ কোটি টাকা। বেসরকারি হিসাবে তা আরো বেশি। এমন দুর্দিনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকার যতটা সাহায্য করছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হাওরাঞ্চলের কৃষকরা ফসল হারান আটবার। তবে এবারের মতো ক্ষতি গত ১২০ বছরেও হয়নি। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কোনো পরিকল্পনা ঊর্ধ্বতন মহল থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে কি না তা আমাদের জানা নেই। যদি নেওয়া হয়, তাহলে সে বিষয়ে গতিশীল উত্তরণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হোক—এটাই এলাকাবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
হাওরে দুর্যোগ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist