মীর আব্দুল আলীম

  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

বিপর্যয়

সড়ক দুর্ঘটনা : এ দায় কার

আমাদের সড়ক-মহাসড়কের সর্বত্রই যেন চলছে বিশৃঙ্খলার মহোৎসব! এতে প্রাণ যাচ্ছে অকাতরে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারির জাতীয় দৈনিক পত্রিকার হিসাবে, বিগত ৩৬ ঘণ্টার ব্যবধানে আমাদের সড়ক কেড়ে নিয়েছে ৫০টি তাজা প্রাণ। আহত হয়েছে আরো শতাধিক ব্যক্তি। হিসাব কষলে প্রতি ঘণ্টায় দেড়জনের প্রাণ গেছে। এভাবে কি দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে মানুষের মৃত্যুর বিভীষিকা চলতেই থাকবে? দেশে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে যে, দুর্ঘটনা রোধে হালে বিশেষ বাহিনী গঠনের দাবি উঠছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে সন্ত্রাসীদের হাতে শতকরা ৩০ জন মারা গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৭০ জন। ৩০ জনের জীবনসহ অন্যান্য জানমাল রক্ষায় সরকারের একটি বাহিনী থাকলে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে থাকবে না কেন? দেশের মানুষের জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দুর্ঘটনা রোধে চরমভাবে ব্যর্থ সরকারকে দেশের মানুষের স্বার্থে যতসম্ভব দ্রুত ভাবতে হবে। বিআরটিএর পরিসংখ্যানমতে, এই সংখ্যা দিনে ১৬ জন এবং বছরে ৫ হাজার ৭৬০ জন। বাস্তবতা হচ্ছে, সড়কে প্রাণ যাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রের কাছে যেন তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪ ঘণ্টায় ২৫ জন মানুষের মৃত্যুর খবর পত্রিকায় ছেপেছে। এ খবর যখন পড়ছি, তখন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীতে আরো ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ওইদিন সড়কে মারা গেছে আরো ২৫ জন। অর্থাৎ, দুই দিনে মারা গেছে ৫০ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুই যেন আমাদের নিয়তি হয়ে উঠছে। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া চালক এবং বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে? দিনের পর দিন এ অবস্থা তো চলতে পারে না। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র মুখ বুজে থাকতে পারে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সড়ক দুর্ঘটনার মূল অনুষঙ্গ বেপরোয়া গতি। চালকরা বেপরোয়া গতিতে এবং একের পর এক পাল্লা দিয়ে যানবাহন চালানোর কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) মতে, মহাসড়কে গড়ে এক মিনিট পরপর একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা করে। একটি গাড়ি আরেকটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গেলেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এটা প্রতিরোধে মহাসড়কে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। সড়কে শৃঙ্খলা নেই বলেই দুর্ঘটনা। আর সরকারের পক্ষ থেকে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগও খুব একটা চোখে পড়ে না। সড়ক নিরাপত্তা শুধু মুখে মুখেই। তবে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক হিসাবে, ২০১৬ সালেই ৪ হাজার ৩১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৬ হাজার ৫৫ জন। আহত হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ। এর আগের বছর প্রাণহানি হয় ৮ হাজারের বেশি মানুষের। আর এটাই বাস্তব চিত্র। দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল ২. মোবাইল ফোন ব্যবহার ৩. অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ৪. ট্রাফিক আইন না মানা ৫. নিয়োজিতদের দায়িত্বে অবহেলা ৬. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা। এই ৬টি বিষয়ে সরকার সজাগ দৃষ্টি দিলে দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু অনেকাংশে কমে যাবে। সড়ক দুর্ঘটনার এমন মৃত্যুর মিছিল যেন নিত্যদিনের দুঃসংবাদ! বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১২ হাজার মানুষের।

বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম। দুর্ঘটনাকবলিত কোনো যানবাহনের চালককে আটক করা হলেও বেশিরভাগ সময়ই তাদের শাস্তি হয় না। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সমস্যা, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা এবং জরুরি ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাহীনতাও দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী। শুধু চালকের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে শতভাগ নৈতিক ও কঠোর থাকতে পারলেই দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এটা ঠিক যে, দেশের বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। এসব যানবাহন চালানোর জন্য চাই দক্ষ ও বিবেচক চালক।

কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশে বৈধ যানবাহনের সংখ্যা ১৩ লাখেরও বেশি। অথচ বৈধ চালকের সংখ্যা মাত্র ৮ লাখ। বাকি যানবাহন যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তাদের লাইসেন্স বৈধ নয়। অনেকের একাধিক লাইসেন্সও আছে। স্বাভাবিকভাবেই অবৈধ লাইসেন্সধারী এসব গাড়িচালক গাড়ি চালাতে গিয়ে আইনের ধার ধারে না। সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত নয়, এমন চালকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এসব চালকের পেছনে রয়েছে শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকতা। এ কারণে তাদের শনাক্ত করাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাই সঙ্গত কারণেই চালকরা বেপরোয়া। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। কেননা, এই পরিস্থিতি একটি দেশের পক্ষে কিছুতেই স্বস্তির হতে পারে না।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন কারণে দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরযানে ১০০টি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এক হাজার মোটরযানে দুর্ঘটনা ঘটে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৫ ভাগ। অন্যদিকে, আমাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার যানবাহনে ১৬৩ জন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ১২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হচ্ছে। নিহতের ৮০ শতাংশের বয়স ৫ থেকে ৪৫ বছর। নিহতদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পথচারী, যাদের ২১ শতাংশের বয়স ১৬ বছরের নিচে। দুর্ঘটনায় আহত ১৫ শতাংশ লোক মারা যায় ঘটনার ১৫ মিনিটের মধ্যে। দেশে ১৬ লাখ রেজিস্টার্ড গাড়ি রয়েছে; আর লাইসেন্স পাওয়া ড্রাইভার রয়েছে মাত্র ১০ লাখ। ৪ লাখ ড্রাইভারের ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং তাদের জন্য ড্রাইভিং ট্রেনিং এবং লাইন্সেস দরকার আছে। তা না হলে প্রতিনিয়তই এভাবে অকাতরে ঝরবে আমাদের প্রাণ। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই থানা পুলিশ পয়সা পেয়ে মীমাংসা করে দিচ্ছে এসব হত্যাকা-ের ঘটনাগুলোর। কতটাই না অসভ্য আমরা। মানুষ মরবে আর ১০-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে সব মীমাংসা হবে, হয়ে যাবে সবকিছু স্বাভাবিক। প্রতি বছরই এভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে; এবং তা রোধ করা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনাÑ এ যেন অলঙ্ঘনীয় ব্যাপার; মৃত্যুদূত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরা যাবে কি? এমন সংশয় বরাবরই থেকে যায়। এই প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব পাওয়া কঠিন বাংলাদেশে। প্রশ্ন হলো, সড়ক দুর্ঘটনায় আর কত প্রাণ ঝরবে! নিত্যনৈমিত্তিক এই সড়ক দুর্ঘটনার দায় কার? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর? প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালমৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে মানুষকে। ফলে এই প্রশ্ন করাটা অসঙ্গত নয় যে, আর কত মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়! এজন্য কি সরকারের কোনো দায় নেই?

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক, কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist