রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

দরকার প্রশ্নহীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন

এ মুহূর্তে দেশের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ লোক বলবে দেশে আরেকটি নির্বাচন দরকার। কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার মতো অধিকাংশ ভোটারই ভোট প্রদান করতে পারেনি। দেশের মালিক জনগণ। এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৯ কোটি ভোটার। দেশের তরুণরা ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। ’৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বাঘা বাঘা নেতাদের হারিয়ে দিয়েছে। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তরুণরা, স্বৈরাচারের পতনও ঘটিয়েছে। সেই উদ্দাম তারুণ্যকে এখন অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে রাজনৈতিক নেতারা স্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছেন। তরুণদের আন্দোলন বিমুখ করে রাখা হয়েছে। এসব থেকে বেরিয়ে আসার উপায় একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন।

আমাদের টাকা নেই। আমরা টাকা সংগ্রহ করার চেষ্টাও করি না। এখন ওরা মানুষের মাথা কেনে। কিন্তু আমরা সেই ৯৯.৯৯ শতাংশ জনগণ যাদের সবাইকে টাকা দিয়ে কেনা যাবে না। তবে রাজনীতির ময়দানে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হচ্ছে অসুস্থ রাজনীতির বিরুদ্ধে সুষ্ঠু রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠার প্রবল প্রচেষ্টা। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সমমনাদের নিয়ে এগিয়ে যেতে। বিজয় নিশ্চিত করা নয়, গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার নির্বাচন দরকার। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মাথায় থাকা উচিত আগামী নির্বাচন। হার-জিত নয়, একটি ভালো নির্বাচন দুই দলের জন্যই জরুরি। দুই দলেরই সমন্বয়, সহযোগিতা ও সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করে পথচলা বাঞ্ছনীয়। তাতে দেশ উপকৃত হবে, জনগণ শান্তিতে থাকবে।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিদেশিদের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করছে। এর আগে বিদেশিরা সামরিক সরকারগুলোর সঙ্গেও কাজ করেছে। কারণ বিদেশিরা রাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করে। আমরা কি সরকার গঠন করলাম সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। দেশ পরিচালনার জন্য একটা সরকার দরকার। সেটা কীভাবে নির্বাচিত হয়েছে সেটি পরের বিষয়। তাই বিদেশিদের গ্রহণযোগ্যতার চেয়ে দেশের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা জরুরি। এই বিষয়টা দেখলেই বর্তমান সরকারের বৈশিষ্ট্য পরিষ্কার হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার এবং বিএনপি তো বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্যতাকে তাদের বড় সমর্থন মনে করছে। দেশের মানুষের সমর্থন না থাকলে বিদেশের সমর্থন খুব বেশি কাজে দেয় না।

নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গঠিত সরকারও যে ব্যতিক্রম কিছু দিতে পারবে সেই বিশ্বাস মানুষের মধ্যে নেই। মানুষ বিশ্বাস করে দৃষ্টান্তে, নমুনা দেখে। তেমন কোনো চিত্র মানুষকে আশান্বিত করেনি। রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন দরকার। যদিও এটা সময়সাপেক্ষ।

অতীতের সকল গণতান্ত্রিক অর্জনে তো ছাত্র সমাজের বড় অবদান ছিল। তরুণ সমাজের মধ্যে চিন্তাশীল গোষ্ঠীটি নীরবে-নিভৃত আছে। তারা পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমে কাজ করছে। এর মাধ্যমে নীরব প্রতিবাদ হচ্ছে। এটাকে খাটো করে দেখার কিছু নেই। কিছুই না হওয়ার চেয়ে একটা কিছু তো হচ্ছে। বিএনপি এখন আন্দোলনে যেতে চায়। তারা তো আন্দোলনে যাবেই। তারা মনে করে, গত নির্বাচন গণতান্ত্রিক হয়নি। এই বিষয়টি সরকারি দলের লোকজনও স্বীকার করে। আন্দোলন শুধু খালেদা জিয়াকেই করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সেটা যে কেউ করতে পারেন। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে সবারই সুযোগ সৃষ্টি হবে।

বিজয়ের সাড়ে চার দশকের বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে? অতীত বর্তমানকে নিয়েই ভবিষ্যৎ। বর্তমানে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। শাসক দলের মধ্যেও শান্তি নেই। কিছু লোক অবৈধভাবে বা দুর্নীতি করে বৈষয়িক লাভবান হচ্ছে, কিন্তু শান্তি নেই। শাসক দলের লোকজন তো অল্প না, সংখ্যায় অনেক। এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন সম্পদ বানাবেন আর সবাই সেটা সমর্থন করবেন, বিষয়টা সে রকম নয়। তাদের মধ্যেও ক্ষোভ আছে। এখন যদি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজ থেকে কোনো উদ্যোগ আসে তাহলে দেখবেন ওই শাসক দলের লোকজনই সমর্থন দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষের সমর্থন তো পাবেই। এই সংসদ গণতান্ত্রিক নয়। আবার ক্ষমতাসীনদের মতে, কোনো রকম সাংবিধানিক প্রক্রিয়া রক্ষা করতে যেহেতু তারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাই সেটাকে আইনগতভাবে অবৈধও বলা যাচ্ছে না। তবে খুব খারাপ একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। তাই আমি মনে করি, এখন নতুন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু করা দরকার। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। কারণ মানুষ এ রকম গণতন্ত্র দেখতে চায় না। ৩১টি দলের মধ্যে বেশিরভাগই সরকারের বিরোধী পক্ষ। কমিশনের সদস্যদের নাম যাচাই-বাছাইয়ের ব্যাপারে দেশের প্রথিতযশা ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির পক্ষভুক্ত; কিন্তু সরাসরি কোনো দলভুক্ত নয়। এদের কাছে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলনিরপেক্ষ, সৎ পরামর্শ জাতি প্রত্যাশা করতেই পারে। কাজেই সার্চ কমিটির ১০ দিনের আয়ুষ্কালের প্রথম দিনের সিদ্ধান্তই ছিল আশাজাগানিয়া। নতুন গঠিতব্য নির্বাচন কমিশনটি কেমন হবে, এখনই তা বলা সম্ভব না হলেও প্রক্রিয়াটি একেবারে অস্বচ্ছ তা বলা যাবে না।

ভালো কিছু আশা করছেন সবাই। সরকারি দলের পক্ষ থেকেও এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন বলে তারাও মনে করছেন। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন সরকার ২০১৪ সালের ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ একটি নির্বাচনের বোঝা টেনে চলেছে। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে পরোক্ষভাবে সে বিষয়টি স্বীকারও করে নেওয়া হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, পরবর্তী সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হোক, তা তিনি চান না। সেই নির্বাচন (দশম সংসদ) সম্পর্কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনোভাব কী ছিল, তা সবারই জানা। বাইরের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গেল তিন বছর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চৌকস নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশের সঙ্গে, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক এবং নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজে মোটামুটি সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পর্কে অনেকেই তাদের নেতিবাচক মনোভাব বদলায়নি বলে ধারণাটা অমূলক নয়। কেউ কেউ মাঝে মাঝে আমাদের দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দ্রুত অনুষ্ঠানের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন এবং তা জাতীয়-আন্তর্জাতিক মিডিয়াও আসে। তিন বছর ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সফর করে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও হয়তো অনুভব করছেন। একটি প্রশ্নহীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ও সেই সংসদের নেত্রী হওয়ার মর্যাদা এবং গৌরবই আলাদা। তাছাড়া পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক বন্ধু রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদক্ষেপ নিতে পারে, যা বাংলাদেশের জনগণ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াতে পারে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার ওপর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বর্তমান শুধু নয়, ভবিষ্যৎও অনেকটা জড়িয়ে আছে। সেজন্য আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গেল ৮ বছরের উন্নয়নমূলক কাজের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ যদি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে, তাহলে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ‘ঝুঁকি’ তাদের নেয়াই উচিত। অপরদিকে বিএনপি কোনো ফাঁকফোকর খুঁজে নির্বাচন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলে দলটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন সঙ্কটের কথা না হয় বাদই দিলাম, দলটির বর্তমান বেহাল দশা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে, তা তাদের গভীরভাবে ভাবা উচিত। নির্বাচনপন্থী দল বিএনপির আবারও নির্বাচন বর্জন হবে আত্মঘাতী। নির্বাচন কমিশন নিয়ে পছন্দ-অপছন্দের বিষয় সামনে এলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের চিন্তা তাদের কোনো অবস্থাতেই পরিহার করা সমীচীন হবে না। হার-জিত নয়, একটি ভালো নির্বাচন দুই দলের জন্যই জরুরি। দুই দলেরই সমন্বয়, সহযোগিতা ও সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করে পথচলা বাঞ্ছনীয়। তাতে দেশ উপকৃত হবে, জনগণ শান্তিতে থাকবে।

লেখক : কলামিস্ট, প্রবাসী

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাজনীতি,রায়হান আহমেদ তপাদার,জাতীয় সংসদ নির্বাচন,ইসি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist