হাসান জাবির

  ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

পারমাণবিক হুমকির উৎসসমূহ

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যবস্থায় সামরিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে বর্ধনশীল উত্তেজনা বিশ্বে একটি যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি এনে দিয়েছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার পর সৃষ্ট নাজুক পরিস্থিতি নিরাপত্তার স্থিতিশীলতাকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত এবং উত্তর কোরিয়ার নিজেদের পরমাণু অস্ত্রের কৌশলগত সক্ষমতা, পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ এবং রণাঙ্গনে মোতায়েনের উৎসাহী প্রবণতা যুদ্ধের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তুলেছে।

মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান এবং ভারতের পারমাণবিক তৎপরতাই এ সংক্রান্ত সাধারণ উৎকণ্ঠার কারণ। আবার উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক তৎপরতার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে পরমাণু অস্ত্র এবং আক্রমণের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছে। একই সঙ্গে সিরিয়া, ইউক্রেন এবং দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন ব্যাপকভাবে পারমাণবিক তৎপরতায় লিপ্ত। এর পাশাপাশি পাকিস্তানের প্রকাশ্য হুমকির মুখে ভারত নিজের পারমাণবিক অস্ত্রের প্রায়োগিক দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ক বাধ্যবাধকতা অনুসরণ না করার প্রবণতা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপ্রবণ করে তুলেছে।

১৯৪৫ ও ১৯৪৯ সালে যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনে সাফল্য পায়। একে আধুনিক পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা বলে মনে করা হয়। রুশ মার্কিন পরমাণু সাফল্যের প্রতিক্রিয়ায় অবশিষ্ট পরাশক্তিগুলো এই প্রযুক্তি হস্তগত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই পর্যায়ে ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে ব্রিটেন ১৯৫২ সালে, ফ্রান্স ১৯৬০ সালে, চীন ১৯৬৪ সালে এবং ভারত ১৯৭৪ সালে সাফল্যজনকভাবে পরমাণু শক্তিকে সামরিক ব্যবহারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। এরপর পাকিস্তান এবং উত্তর কোরিয়া যথাক্রমে ১৯৯৮ ও ২০০৬ সালে পরমাণু শক্তিধর দেশের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম লেখাতে সক্ষম হয়। এর বিপরীতে দক্ষিণ আফ্রিকাই একমাত্র রাষ্ট্র, যারা পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনের সব ধরনের কলাকৌশল রপ্ত করা সত্ত্বেও বিশ্বের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থে অস্ত্র উৎপাদন থেকে বিরত থাকে।

অন্যদিকে, ২০১৫ সালে সম্পাদিত ইরান এবং ছয় বিশ্বশক্তির মধ্যে সম্পাদিত পরমাণু সমঝোতা চুক্তি ছিল নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ক বড় সাফল্য। এই প্রক্রিয়ায় ইরানের পরমাণু প্রকল্পের সক্ষমতা হ্রাস করা সম্ভব হয়। কিন্তু নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ইরানের এ সংক্রান্ত বাকবিত-া বৃদ্ধির ফলে চুক্তির কার্যকারিতা গুরুতর হুমকির মুখে। এমন পরিস্থিতিতে ইরান নতুনভাবে তার পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের কার্যক্রম শুরু করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। আবার, কোনো ধরনের পরীক্ষা না করলেও ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়, ইসরাইলের হাতে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। ইসরাইলের এই অপ্রকাশ্য সক্ষমতাই বৈশ্বিক পরমাণু স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি।

গত বছর প্রকাশিত দুটি পরস্পরবিরোধী পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রের মজুদের সংখ্যা ১৬ হাজার ৩০০টি অথবা ১৫ হাজার ৬৫০টি। পরিসংখ্যানে ৯টি স্বীকৃত পরমাণু শক্তিধর দেশের উপাত্ত বিবেচনা করা হলেও মোট ১৪টি দেশে এ ধরনের অস্ত্র মজুদ কিংবা মোতায়েন রয়েছে। পরিসংখ্যানের এই দিকটি স্পষ্ট করে যে, স্বীকৃত পরাশক্তিগুলো নিজের মূল ভূ-খ-ের বাইরের সামরিক ঘাঁটিতেও পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন রেখেছে। ধারণা করা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে এবং রাশিয়া সিআইএসভুক্ত দেশে, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও এই মারণাস্ত্র মোতায়েন রাখতে পারে।

বিশ্বে মজুদ পরমাণু অস্ত্রের ১০ হাজারই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে সংশ্লিষ্ট দেশের সেনাবাহিনী। এর মধ্যে শত্রুসেনাকে লক্ষ্য করে মোতায়েনকৃত অতি সক্রিয় ১৮০০ অস্ত্র মাত্র কয়েক মিনিটের নোটিশেই চূড়ান্ত আঘাত হেনে শত্রুপক্ষের অকল্পনীয় ধ্বংস সাধন করতে সক্ষম। এ ধরনের একটি পরমাণু অস্ত্রের আক্রমণ কত ভয়াবহ হতে পারে, তা অনুমান করাও কঠিন। ১৯৪৫ সালে জাপানে নিক্ষিপ্ত পরমাণু বোমার চেয়ে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রগুলোর ধ্বংসক্ষমতা বহুগুণ বেশি। হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমাটির ধ্বংসক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার টন টিএনটি। আর বর্তমান অস্ত্রগুলোর ধ্বংসক্ষমতা পরিমাপ করা হয় মেগাটনে। মাত্র ২০ মেগাটন শক্তিসম্পন্ন একটি পরমাণু যুদ্ধাস্ত্র জাপানে নিক্ষিপ্ত বোমার চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। ১৯৫৪ সালে হাইড্রোজেন বোমার সাফল্যের অব্যবহিত পর ১৯৫৭ সালে কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ আধুনিক পরমাণু গবেষণায় চাঞ্চল্যকর পরিবর্তন আনে। এই দুই বৈজ্ঞানিক মহাসাফল্যের ভিত্তিতে পরাশক্তিগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ান ফেডারেশন অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরিতে মনোনিবেশ করে। লক্ষণীয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রায় ৭ হাজার পরমাণু যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে, যার মধ্যে ২ হাজার ৩৪০টি ত্রুটিপূর্ণ। এগুলো সংস্কারাধীন। ২ হাজার ৬৮০টি যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োজনীয় মুহূর্তে মোতায়েনের জন্য নিরাপদ স্থানে সংরক্ষিত রয়েছে। অবশিষ্ট ২ হাজার ৮০টি অস্ত্র শত্রুসেনাকে লক্ষ্য করে মোতায়েন করা আছে।

অন্যদিকে, পরিসংখ্যান নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি থাকলেও রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশটি নিজের পরমাণু অস্ত্রভা-ার সম্প্রসারণে ব্যাপকভাবে তৎপর। ইতোমধ্যে দেশটি নতুন প্রজন্মের পরমাণু অস্ত্র উৎপাদন ও মোতায়েনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণের দ্বারপ্রান্তে আছে। ইউক্রেন সংকটের জেরে দেশটি ক্রিমিয়ায় অতিরিক্ত এবং উন্নত পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন করেছে, যা ইউরোপীয় সামরিক নিরাপত্তার গতানুগতিক কৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে এবং পশ্চিমাদেরকে দুশ্চিন্তায় ফেলে।

আবার, ২৫০টি পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী চীনের পরমাণু প্রকল্পই বৈশ্বিক সামরিক কৌশলে সর্বাধিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বেইজিং নিজের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ ধরনের প্রতিযোগিতার ভারসাম্য ফেরাতে উদগ্রীব। ইতোমধ্যে দেশটি সমুদ্রভিত্তিক পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করেছে। মূলত চীন-মার্কিন পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিস্তার এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ব্যাপক হুমকি বলেই বিবেচনা করা হয়। আরেক উদীয়মান শক্তি ভারতের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ১১০টি। দেশটির পরমাণু অস্ত্রবাহী আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র অগ্নি-৫ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামরিক কৌশলের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। এর সঙ্গে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম সুপারসনিক গতির ব্রাহ্ম ক্ষেপণাস্ত্র সব পক্ষের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক। রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে উৎপাদিত এই ক্ষেপণাস্ত্র ভারতকে সামরিক পরাশক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ফ্রান্সের কোনো পরমাণু অস্ত্রই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত নয়, যদিও ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই দাবি যুক্তরাজ্য সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৯৭ সালে সর্বশেষ পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে বিতর্কের মুখে পড়া ফ্রান্সের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ৩০০টি। মাত্র দুই দিন আগে দেশটির একটি পরমাণু প্রকল্পে সামান্য বিপর্যয় নেমে আসে। বিশ্বব্যবস্থায় ক্রমেই আধিপত্য হারানো যুক্তরাজ্যের ৪টি সাবমেরিনের প্রত্যেকটিতে ১৬টি করে পরমাণু অস্ত্র মজুদ আছে। ক্রমেই সীমিত হয়ে পড়া যুক্তরাজ্যের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা মাত্র ২১৫টি। এছাড়া পাকিস্তানের হাতে কিছু পরমাণু অস্ত্র আছে। অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্রের সক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক সংশয় রয়েছে, যদিও দেশটির দাবি, পিয়ং ইয়ং সাবলীলভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে পরমাণু আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়া, দক্ষিণ চীন সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন ব্যাপকভিত্তিক পরমাণু অস্ত্রের মহড়া চালিয়ে প্রতিপক্ষকে ভীতি প্রদর্শন করছে। এ ধরনের আগ্রাসী কর্মকা- বস্তুত বিশ্বজুড়ে এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করেছে। ফলে এই আশঙ্কা অমূলক নয় যে, পরাশক্তিগুলোর পরিবর্তিত আগ্রাসী তৎপরতায় বৈশ্বিক পরমাণু নিরাপত্তার স্থিতিশীলতা চরম হুমকিতে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ ধরনের আগ্রাসী তৎপরতা কার্যত বৈশ্বিক পরমাণু নিরাপত্তা সুরক্ষার প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পরমাণু হামলা,যুদ্ধ,আন্তর্জাতিক
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist