আন্তর্জাতিক
উদারপন্থি রাজনীতিক রাফসানজানি
রায়হান আহমেদ তপাদার
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি ইন্তেকাল করেছেন। সম্প্রতি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাফসানজানি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি আহমেদিনেজাদের কাছে পরাজিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দেশটির এক্সপেডিয়েন্সি কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই কাউন্সিলের কাজ হলো পার্লামেন্ট ও গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মধ্যকার মতবিরোধ দূর করা। এই কাউন্সিলের ক্ষমতাও অনেক। ২০১৩ সালে তিনি সংস্কারপন্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করতে গেলে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল এই কাউন্সিল। এরপর তিনি হাসান রুহানিকে সমর্থন জানান। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও একজন আধুনিক এবং উদারপন্থি রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। রুহানি এবং তার মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। রাফসানজানিকে মৃত ঘোষণার আগে তেহরানের শুহাদা হাসপাতাল থেকে প্রেসিডেন্ট রুহানিকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে। রাফসানজানির স্বজন হোসেন মারাশির বরাত দিয়ে ইরানের বার্তা সংস্থা তাসনিমে জানায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে দেশটির উত্তরাঞ্চলের শুহাদা হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। রাফসানজানির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালের সামনে ভিড় করে। এছাড়া তাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও।
রাফসানজানি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৪ সালের ২৫ আগস্ট। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইরানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছিলেন ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদের চেয়ারম্যান। রাজনীতির বাইরে লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এই কৃতী রাজনীতিক।
ইরানের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও আলেম আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি ইরানের রাফসানজান এলাকার বাহরেমান গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর ১৪ বছর বয়সে তিনি ধর্মীয় উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য পবিত্র কোম নগরীতে যান। সেখানে তিনি আয়াতুল্লাহিল উজমা হোসেইন তাবাতাবায়ি বোরুজেরদি, ইমাম খোমেনি সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ মোহাক্কেক দামাদ, মোহাম্মাদ রেজা গোলপায় গানি, সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ কাজেম শারিয়াতমাদারি আব্দুল কারিম হায়েরি ইয়াজদি, শাহাবুদ্দিন মারআশি নাজাফি ও মোহাম্মাদ হোসেইন তাবাতাবায়ির মতো প্রখ্যাত আলেমে দ্বীনের সংস্পর্শ লাভ এবং তাদের কাছ থেকে মূল্যবান ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন। কোমের ছাত্র থাকা অবস্থায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থপতি ইমাম খোমেনি (র.)-এর অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি। তিনি তৎকালীন স্বৈরাচারী শাহ সরকার এবং তার কথিত শ্বেত বিপ্লবের বিরোধিতায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই আন্দোলনে ইরানের আপামর জনতা অংশগ্রহণ করে এবং এর ফলে ১৯৭৯ সালে শাহ সরকারের পতনের মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লব চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। সুদীর্ঘ বিপ্লবী ও কর্মময় জীবনে আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি ইরানের প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট স্পিকার, নীতিনির্ধারণী পরিষদের প্রধান এবং বিশেষজ্ঞ পরিষদের চেয়ারম্যানসহ অনেক বড় বড় পদে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ছিলেন ইসলামী ইরানের পার্লামেন্ট মজলিসে শূরায়ে ইসলামীর প্রথম স্পিকার। এছাড়া ১৯৮৯ সালে তিনি ইরানের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৩ সালে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জয়লাভ করে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সফর করেন ইরানের এই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের ফ্রন্ট পরিদর্শনের পর ওই যুদ্ধ বন্ধে আয়াতুল্লাহ রাফসানজানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকে আমৃত্যু তিনি ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদে জননির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। পিতা আলহাজ মির্জা আলী হাশেমি বাহরেমানি। মাতা মাহ বিবি (সাফারিয়ান)। প্রপিতামহের নাম ছিল আলহাজ হাশেম। এখান থেকেই বংশের নাম হয়েছে হাশেমি। এলাকায় আলহাজ হাশেমের অঢেল সম্পত্তি ছিল। এক নামে তাকে চিনত সবাই। পিতা ধর্মীয় লাইনে লেখাপড়া করেছিলেন। আলেম সমাজের ওপর স্বৈরাচারী শাহ সরকারের দমন-পীড়নের কারণে পিতা প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও গ্রামে বসবাস করতে বাধ্য হন। এলাকার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়; এবং সমাজের বিচার-আচারসহ সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ও সমস্যার সমাধান করে দিতেন তার পিতা। গ্রামের নাম বাহরেমান। ‘বাহরেমান’ শব্দের অর্থ- চুনিপাথর। রাফসানজান এলাকার একটি গ্রাম এটি।
মা ছিলেন একজন গৃহিণী। পিতার কাজেও সাহায্য করতেন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও ঔষধি গাছগাছালি সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান ছিল। তার এই জ্ঞান বাড়ির লোকজনের পাশাপাশি গ্রামবাসীর অনেক উপকারে আসত। রোগ-বালাইয়ে পড়লে লোকজন মায়ের শরণাপন্ন হতো। এখনো নানা রোগে মায়ের সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান পরিবারের সদস্যরা। তারা পাঁচ ভাই, চার বোন। গ্রামে বসবাস করলেও জীবনযাত্রার মান খারাপ ছিল না। জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মসাল হচ্ছে ১৯৩৪। পাঁচ বছর বয়সে দুই বছরের বড় ভাই কাসেমের সঙ্গে লেখাপড়া শুরু। গ্রামের মক্তবে জাতীয় পাঠ্যক্রমের বই পড়ানোর পাশাপাশি পবিত্র কুরআনসহ অন্যান্য ধর্মীয় বই পড়ানো হতো। ওই মক্তবে শেখ সাদির ‘গুলিস্তান’ বইটি পড়তে শেখেন। সাত বছর বয়সে মক্তবের লেখাপড়ার পাশাপাশি পিতার কাছ থেকেও তালিম নেন। একটা পর্যায়ে এসে তিনি অনুভব করেন, মক্তব তাকে নতুন আর কিছু শেখাতে পারছে না। তখন বয়স ১৪ বছর। সেই সময় চাচাতো ভাই মোহাম্মাদের পরামর্শে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কোম শহরে যান। কোমের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে তিনি বিখ্যাত সব আলেমে দ্বীনের কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করেন। সেসব আলেমের মধ্যে ছিলেন আয়াতুল্লাহিল উজমা বোরুজেরদি, ইমাম খোমেনি (র.), দামাদ, গোলপায়গানি শারিয়াতমাদারি, হায়েরি ইয়াজদি, মারআশি নাজাফি, আল্লামা তাবাতাবায়ি, জাহেদি ও মোনতাজেরি। ১৯৫৮ সালে হুজ্জাতুল ইসলাম আগা সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ সাদেক মারআশির কন্যার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী মারআশি নাজাফির আত্মীয়া এবং হজরত আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ কাজেম তাবাতাবায়ি ইয়াজদির নাতনি। আয়াতুল্লাহ তাবাতাবায়ির লেখা বই ইরানের প্রায় সব ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে আজও রেফারেন্স হিসেবে পড়ানো হয়।
সুখী দাম্পত্য জীবনে মহান আল্লাহ তাদেরকে পাঁচটি সন্তান দিয়েছেন। তারা হলেন ফাতেমা, মোহসেন, ফায়েজা, মাহদি এবং ইয়াসির। ইরানের নীতিনির্ধারণী পরিষদের প্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ আকবর হাশেমি রাফসানজানি বলেছেন, নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময়ও শেষ হয়ে গেছে।
নির্বাচনে ভোটারদের বিপুল উপস্থিতিকে তিনি ইরানের ইসলামী শাসনব্যবস্থার জন্য ‘মূল্যবান সম্পদ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এই নির্বাচন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।
রাফসানজানি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নীতিনির্ধারণী পরিষদের প্রধান আয়াতুল্লাহ আকবর হাশেমি রাফসানজানি বলেছেন, তার দেশ স্বাধীনতার পথ অক্ষুণœ রেখেই আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর নীতি অনুসরণ করবে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ এবং অভ্যন্তরীণ সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ইরান জোরালোভাবে তার স্বাধীনতা রক্ষার নীতি অনুসরণ করবে এবং আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গেও যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়াবে। নিউইয়র্কে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির মধ্যকার বৈঠকের কথা উল্লেখ করে রাফসানজানি বলেন, দৃশ্যত ইউরোপের সঙ্গে ইরানের বাণিজ্যিক ও ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে যেসব বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা দূর হয়েছে।
গত জুলাইয়ে ইরান এবং ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পরমাণু ইস্যুতে সমঝোতা হওয়ার পর চলতি বছর ১৬ জানুয়ারি তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। তবে ইরান বলে আসছে, তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নীতিনির্ধারণী পরিষদের প্রধান আয়াতুল্লাহ আকবর হাশেমি রাফসানজানি বলেছেন, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইল লাভবান হবে। তিনি আরো বলেন, এই দুই মুসলিম দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়লে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গোটা মুসলিমবিশ্বের অবস্থান শক্তিশালী হবে। কিন্তু এই দুটি দেশের মধ্যে মতবিরোধের কারণে মুসলমানদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর এর ফলে মুসলমানদের শত্রুরা, বিশেষ করে ইহুদিবাদী ইসরাইল লাভবান হচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আসলে এটি একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ, যা দখলদার ইসরাইলের স্বার্থে করা হয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরব এবং এর কয়েকটি মিত্র দেশ মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় সংগঠন হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। যে হিজবুল্লাহ মুসলিমবিশ্বের প্রধান শত্রু ইহুদিবাদী ইসরাইলের মোকাবিলায় প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছে, সেটাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করায় বিশ্বের মুসলমানরা বিস্মিত হয়েছেন।
লেখক : কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য
raihan567@ yahoo.co.uk
পিডিএসও/মুস্তাফিজ
"