রিহাব মাহমুদ
কিংবদন্তি এক মহানায়িকার স্মৃতি
শুরুতে ২৪ ঘণ্টার হাতে কিংবদন্তি বাংলার মহানায়িকার শেষ কয়েকটি মুহূর্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানাচ্ছি। ১৬ জানুয়ারি ২০১৪। বৃহস্পতিবার রাত দশটা থেকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে সুচিত্রা সেনের। বহু কষ্টে নেবুলাইজেশনের জন্য তাকে রাজি করানো হয়। রাতে দফায় দফায় বাড়ানো হয় ভেন্টিলেশন। দুই নাতনী রাইমা-রিয়া রাজি থাকলেও মায়ের কষ্ট দেখে দেহে আরও নল ঢোকাতে রাজি হচ্ছিলেন না সুচিত্রা-কন্যা মুনমুন।
শুক্রবার সকাল পৌনে আটটা পর্যন্ত জ্ঞান ছিল মহানায়িকার। নল ঢোকাতে গেলে বারবার হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। এরপরই শুরু হয় প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। সকাল থেকেই ওঠানামা করতে থাকে রক্তচাপ। রক্তচাপ স্থিতিশীল করতে বুকে পাম্প শুরু করেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু সকাল আটটার পর মহানায়িকার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটে। সেই সময় ঘরে ছিলেন দুই জুনিয়র ডাক্তার। হাসপাতালে থাকলেও সে সময় কেবিনে ছিলেন না মুনমুন সেন। ওই ডাক্তাররা ফোন করেন মুনমুন সেনকে। এরপরই কেবিনে ছুটে এসে তিনি মৃত্যুসংবাদ পান। কান্নায় ভেঙে পড়েন সুচিত্রা কন্যা।
বেলা ৩টায় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে হয় তার শেষকৃত্য। তারপর CR দাস পার্কে চন্দনের চিতায় দাহ করা হল তাকে। মুখাগ্নি করেন তার মেয়ে মুনমুন সেন। তার আগে গান স্যালুটে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। তেইশে ডিসেম্বর শ্বাসকষ্ট এবং বুকে সংক্রমণ নিয়ে বেলভিউতে ভর্তি হয়েছিলেন মহানায়িকা। তারপর টানা ছাব্বিশ দিন তাকে বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে গেছেন চিকিৎসকরা। ১৭ জানুয়ারি সকাল আটটা পঁচিশে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে শেষ হয়েছিল সব লড়াই। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ সুচিত্রা সেনকে নিয়ে বেলভিউ ক্লিনিক থেকে বের হয়েছিল শববাহী শকট। মহানায়িকাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় তার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে। সেখান থেকে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ঘুরে দেহ পৌছায় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে।
মহানায়িকার দুটি দুর্লভ ছবি
১৯৭৮ থেকে ২০১৪- প্রায় তিনটি যুগ ঠিক কোন অভিমানে এ মহানায়িকা সুচিত্রা নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন- শেষ পর্যন্ত তা হয়তো অজানাই থেকে যাবে তিন প্রজন্মে ছড়িয়ে থাকা অগণিত ভক্তের।
পাবনার মেয়ে উপমহাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের আজ তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ তার কিশোরীবেলার বিদ্যাপীঠ পাবনা টাউন গার্লস হাই স্কুল প্রাঙ্গণে (মহাকালী পাঠশালা) এক স্মরণসভার আয়োজন করেছে।
বৃহত্তর পাবনার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সেন ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল জন্ম নেন সুচিত্রা। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হিমসাগর লেনের একতলা পাকা পৈতৃক বাড়িতে সুচিত্রা সেনের শিশুকাল, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। তার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে চাকরি করতেন। মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত ছিলেন গৃহিণী। দু'বোনের মধ্যে সুচিত্রা সেন ছিলেন বড়। পাবনা শহরের নানা অনুষ্ঠানে গান গাওয়া ও নাটক-থিয়েটারে তিনি অভিনয়ে দক্ষতা দেখান। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ক'মাস আগে কলকাতা যাওয়ার বছর দুয়েক পরেই সেখানকার বনেদি পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে রমা দাশগুপ্তের বিয়ের পর নাম হয় সুচিত্রা সেন। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে 'শেষ কোথায়' নামের একটি বাংলা ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। অজ্ঞাত কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি। এর পর ১৯৫৩ সালে নায়িকা হয়ে তার অভিনীত প্রথম ছবি 'সাত নম্বর কয়েদি' মুক্তি পায়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর সুচিত্রা সেন একটানা বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেন। সুচিত্রা সেন বাংলা ৫৬টি ও সাতটি হিন্দি মিলে মোট ৬৩টি ছবিতে নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি হয়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে উত্তম কুমার মারা গেলে সিনেমায় অভিনয় বন্ধ করে দেন সুচিত্রা। ১৯৬৩ সালে সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস জয় করেন। তিনি প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী, যিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ভারত সরকারও তাকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে।
২০০৫ সালে তাকে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি জনসমক্ষে আসতে চাননি বলে তা গ্রহণ করেননি।