মাসউদুল কাদির

  ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭

ইসলামে স্বাধীন চিন্তার গুরুত্ব

চিন্তার অধিকার মানুষের একটি স্বভাবজাত অধিকার। একজন মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে। সব মানুষই যেকোনো বিষয়ে ভাবতে, গবেষণা করতে পারে। ইসলাম মানুষের এই স্বাধীনতার ওপর কোনো জোরজবরদস্তি করে না। কারণ, ইসলাম হলো ফিতরাতের এক জীবনব্যবস্থার নাম। ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রেও চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে। দেখে, শুনে ও বুঝে তবেই ইসলাম গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। হজরত সালমান ফার্সি রা. ইসলাম গ্রহণের আগে নানা মতবাদের দীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, চিন্তা-ফিকির ও গবেষণা করেছেন। সর্বশেষ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে হাত রেখে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মাদ সা. কারো ওপরই জোর খাটাননি, বাধ্য করেননি।

কালো-সাদা, আরব-অনারব, পরাধীন-ক্রীতদাস রূপে কেউ জন্মলাভ করে না। বরং জন্মগ্রহণকারী শিশুর একটাই পরিচয়, সে মানুষ। মানুষ হিসেবে একটি স্বাধীন শিশু হয়েই সে পৃথিবীতে আসে। মানুষ তাকে পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে। হজরত উমর বিন খাত্তাব রা. বলেন, ‘তোমরা কবে থেকে তাদের ক্রীতদাস বানিয়েছ, অথচ তাদের মায়েরা তো তাদেরকে স্বাধীন হিসেবেই জন্ম দিয়েছে!’

স্বাধীন থাকা, স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, স্বাধীনভাবে ভাবার অধিকার শিশুর জন্মগত। এই অধিকার হরণের অবকাশ নেই। হজরত আলী রা. বলেছেন, ‘অন্যের জীবনকে যাপন করো না, আল্লাহ তোমাকে স্বাধীন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।’

ক্রীতদাসমুক্ত সমাজ নিজেদের চোখে বিনির্মাণের এক স্বপ্নময় অধ্যায় প্রত্যক্ষ করেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম রা.। এ কারণে নবীজির সহচরগণ সারা জীবন মানবতার সর্বতো কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তাদের ধারাবাহিকতায় অলিআল্লাহ, গাউস-কুতুব এবং ওলামায়ে কেরাম মানবতার মুক্তির জন্য মানুষের স্বাধীন মতামতের ওপরই কার্যত অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন।

মতপ্রকাশ এবং স্বাধীন চিন্তা ব্যক্ত করার অধিকার সবার থাকলেও কখনোই সীমালঙ্ঘনকে ইসলাম সমর্থন করে না। কারো ওপর কটাক্ষ করার যৌক্তিকতা নেই। কাউকে উসকে দিয়ে কোনো স্বার্থ হাসিলেও উৎসাহিত করে না। পবিত্র কুরআনে আছে, ‘লিমা তাকুলূনা মা লা-তাফ্আলূন’ অর্থাৎ, ‘তোমরা কেন এমন কথা বলো, যা তোমরা করো না।’

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কু আন্ফুসাকুম’ (তোমরা নিজেকে বাঁচাও)। এরপর পরিবার এবং অন্যকে বাঁচানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চিন্তার স্বাধীনতা এই নয় যে, ব্যক্তি যাচ্ছেতাই চিন্তা করে বেড়াবে, বলে বেড়াবে, রটনা করে বেড়াবে। দেশ, জাতি এবং মানুষের কল্যাণচিন্তাই কেবল মানুষ করতে পারে। ‘বাল্হুম আদাল্ল’ অর্থাৎ ‘পশুর চেয়ে অধম’ হতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলামে সবাইকে সীমালঙ্ঘন না করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে।

ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বরূপ

ইসলামে কোনো বাড়াবাড়ি নেই। ধর্ম নিয়ে কোনো রেষারেষি নেই। ইসলাম সমতা ও সাম্যের জীবনব্যবস্থার নাম। ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শান্তি, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বপরায়ণ এক রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন মদিনায়। মদিনার অন্যান্য ধর্মীয় বেত্তার সঙ্গে যে শান্তিচুক্তি করেছিলেন, তা এখনো ‘মদিনা সনদ’ নামে পৃথিবীখ্যাত হয়ে আছে। মদিনার সংবিধানের কোনো না কোনো পয়েন্ট পৃথিবীর তাবৎ সংবিধান রচনায় কাজে লেগেছে।

ইসলাম মানতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। কোনোকিছুর প্রলোভন দেখিয়েও কাউকে ইসলামে টানা যাবে না। কেবল স্বেচ্ছায়, বুঝেশুনে, সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবেচিন্তে ইসলামে আত্মসমর্পণ করলেই মুসলমান হবে। মানুষের বিশ্বাসকে ইসলামে অবমূল্যায়ন করা হয়নি। ইসলাম কোনো চাপাচাপির জায়গা নয়—

‘(হে নবী) আপনার মালিক চাইলে এই জমিনে যত মানুষ আছে, তারা সবাই ইমান আনত। (কিন্তু তিনি তা চাননি, তাছাড়া) আপনি কি মানুষকে জোরজবরদস্তি করবেন, যেন তারা সবাই মুমিন হয়ে যায়!’ (সূরা ইউনুস, আয়াত- ৯৯)

মক্কায় নবীজির ওপর এ রকম আয়াত হয়েছে। নবীজি সা. চাইতেন, মক্কার আবু জেহেল এবং উমরসহ সবাই ইসলামের আলোকে আলোকিত হোক। সত্য ও সমৃদ্ধির পথে মানুষকে নিয়ে আসতে নবীজি যারপরনাই চেষ্টা করতেন। মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরত করার পর আরো স্পষ্টভাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(আল্লাহর) দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোরজবরদস্তি নেই। (কারণ) সত্য (এখানে) মিথ্যা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৫৬)

কুরআনের চমকিত এই ঘোষণায় মুসলমানরা যেন থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। মানবতার নবী রাসূলুল্লাহ সা. জোরজবরদস্তি করা যাবে না দিয়ে যার যার ধর্ম পরিপালনে অসাম্প্রদায়িক এক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এই মতপ্রকাশে বিশ্ববাসীও নড়েচড়ে বসে। কারণ, তখন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বলত, ‘হয় খিস্টান হও, নয় তো খুন হও।’ মুসলমানরা যখন ইহুদি মতবাদ থেকে নিজেদের সন্তানদের জোর করে ইসলামে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তখনই আল্লাহর রাসূল সা. ধর্মীয় স্বাধীনতার এই ঘোষণা দিয়েছিলেন।

আজ ধর্ম নিয়ে তো নতুন করে বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই। এটা ইসলামেরও কোনো বিধান নয়। তাই ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ, পালনে কোনো বাধা না দেওয়া ইসলামেরই নির্দেশনা।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইসলামে স্বাধীন চিন্তা,মাসউদুল কাদির,ধর্ম,চিন্তা,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist