কামার ফরিদ

  ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭

ব্যবসায়ীদের রক্ষা করবে কে

খাবার তালিকায় ডাল-ভাত অথবা রুটি-তরকারি থাকলে তাকে আমরা সাধারণ খাবার বলি। দেশের বেশির ভাগ মানুষই এ তালিকায় অভ্যস্ত। এর বাইরেও কিছু লোক আছেন, যাদের খাদ্য তালিকাটা একটু ভিন্ন। এরা পোলাও, কোর্মা, বিরিয়ানি, রোস্ট অথবা কাবাব ও মিষ্টান্ন সহযোগে ভোজনপর্ব সারতে ভালোবাসেন। এদের সংখ্যা বেশি না হলেও নগণ্য বলা যাবে না। তবে এর বাইরেও আরো কিছু লোক আছেন—সংখ্যায় এরা খুবই নগণ্য হলেও সমাজে বেশ গণ্যমান্য। পোশাকে-আশাকে ভদ্র এবং কেতাদুরস্ত। এদের খাদ্য তালিকার সঙ্গে অন্য কারো খাদ্য তালিকার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

প্রিয় খাবার এক টুকরো জমি। যত খুশি সার্ভ করা হোক না কেন, উদরপূর্তিতে এদের সময় লাগে না। অনেকটা ব্ল্যাক হোলের মতো এদের পাকস্থলী। গোটা পৃথিবীও যদি সার্ভ করা হয়—এদের কোনো না নেই। শিকার করে আহার করতে ভালোবাসেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে বন্য প্রাণীর চেয়েও হিংস্র।

ক্ষুধা পেলে খাদ্য তালিকায় হানা দিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করা বন্যদের স্বভাব। টার্গেট করেই এরা হত্যা করে। তারপর লাঞ্চ অথবা ডিনার পর্বের কাজ সারে। তবে ক্ষুধার্ত না থাকলে এরা কোনো হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয় না। এটাই বন্য প্রাণীকুলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

বন্য প্রাণীর সঙ্গে এদের ফারাক এখানেই। একপক্ষ একবেলা আহার জোগাড়ের জন্য শিকারের ওপর আক্রমণ চালায় এবং হত্যা করে। কিন্তু অপর পক্ষের ক্ষুধার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এদের সীমাহীন এই ক্ষুধা নিবারণের কোনো ব্যবস্থা এ যাবৎ গড়ে ওঠেনি। শিকার দেখলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই যেন জমি বা ভূমি খাদকদের এক বিকৃত অভ্যাস। বাংলাদেশের কত জমিই না এদের উদরে গিয়ে জমা হয়েছে—তার কোনো সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এই গোত্রের সবাই আবার এ রকম নয়। ব্যতিক্রমও আছে। সমাজে এই ভূমি খাদকরা আজ ভূমিদস্যু হিসেবেই পরিচিত।

সে রকম এক ভূমিদস্যুর নাম মেট্রো গ্রুপ। গুলশান ১-এর সাত বিঘা জমি উদরে চালান দেওয়ার জন্য দীর্ঘ দশ বছর তারা চেষ্টা করেছে। কিন্তু শিকারকে থালায় সাজাতে পারেনি। শেষ চেষ্টার অংশ হিসেবে রাতের অন্ধকারে আগুন দিয়ে ডিসিসি মার্কেটটি পুড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষায় আছে। অভিযোগগুলো আমার নয়। ৭০০ দোকান মালিকের।

গুলশান-১ এলাকায় সাত বিঘা জমির ওপর নির্মিত ডিসিসি মার্কেট এখন একটি ধ্বংসস্তূপ। অভিযোগকারীরা বলেছেন, জমি দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফায়দা লুটার জন্য মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে—এত বেশি হীনম্মন্যতার পরিচয় দিতে পারে তা ভাবা যায় না। তারা বলেছেন, এ জায়গাটি দখলে নিতে মেট্রো গ্রুপ নামের এই নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রকার অপচেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে মেট্রোর এ প্রচেষ্টা সফল হতে পারেনি। অবশেষে রাতের অন্ধকারে গান পাউডার ছিটিয়ে মার্কেটটি ধ্বংস করা হয়েছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, কয়েক মাসের মধ্যে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি প্রভাবশালী মহলের আনুগত্য লাভে সক্ষম হবে এবং তাদেরই ছত্রছায়ায় জায়গাটি দখলে নেবে। তবে দোকান মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, জীবন থাকতে তারা এই অশুভ চক্রকে তাদের পরিকল্পনা সফল হতে দেবেন না। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য এবং অধিকার বুঝিয়ে দিয়েই তা করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (উত্তর) দোকান মালিক পক্ষের বুকের ওপর বুলডোজার চালিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।

যে যাই বলুক, আগুনে পুড়েছে ডিসিসি মার্কেট। ইহাই সত্য। তিন শতাধিক দোকান সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই শতাধিক। আর ধসে পড়েছে মার্কেটের তিনতলা ভবন। রাত ২টার দিকে মার্কেটের কাঁচাবাজার থেকে আগুনের সূত্রপাত। কিছুক্ষণের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। টানা ১৬ ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস তা নিয়ন্ত্রণে আনে।

ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ব্যবসায়ীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, নাশকতার আশঙ্কা ৯৯ শতাংশই নেই। বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই আগুন লেগেছে। তার এই বক্তব্য শোনার পর পরই দোকান মালিকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, কোনোপ্রকার তদন্ত ছাড়াই মেয়র আনিসুল হক কী করে নিশ্চিত হলেন বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই আগুন লেগেছে। এদিকে মার্কেট নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মতিউর রহমান জানিয়েছেন, রাত ২টায় তিনি একটি বিকট শব্দ শুনতে পান। শব্দের দিকে লক্ষ করতেই দেখেন মার্কেটের পূর্ব পাশে ট্রান্সফরমারে আগুন। মুহূর্তেই কাঁচাবাজারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

সাতবিঘা জমির ওপরে এ মার্কেটের পাকা অংশটি গড়ে ওঠে ১৯৬২-৬৩ সালে। ৮৩ সালে সিটি করপোরেশন কাঁচা মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেয়। ২০০০ সালে দুটি পিলারে ফাটল দেখা দিলে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। পরে মেরামত করে চালানো হয়েছে। ২০০৩ সালে তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলে এ জায়গায় ১৮ তলা গুলশান ট্রেড সেন্টার নির্মাণের দরপত্র দেন। কিন্তু নানা প্রকার অসামঞ্জস্যের কারণে সে প্রকল্প আর বেশি দূর এগোতে পারেনি। সিটি করপোরেশনের এ ধরনের অসামঞ্জস্যের গল্প শহরের অলিগলিতে ওপেন সিক্রেট হিসেবেই আলোচিত হয়ে থাকে। তাতে করপোরেশনের কোনো মাথা ব্যথা নেই। অনৈতিকভাবে উপার্জিত অর্থে ওরা সব সময়ের জন্য সুখে-সম্পদে ভালোই থেকেছেন এবং এখনো আছেন।

তারা সুখে থাকুন, এতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তখনই আপত্তি ওঠে—যখন দেখি তাদের কারণেই ব্যবসায়ীরা কোটিপতি থেকে পথের ভিখারি হয়েছেন। এখন আর তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। চতুর্দিকে যেন অমাবস্যার ঘনকালো অন্ধকার।

ঘটনাস্থলে এসে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সংসদ সদস্য রহমত উল্লাহ বলেছেন, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, ভবন নির্মাণ করে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুনর্বাসন করা হবে।

এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শন আগুন লাগার ব্যাপারে সঠিক তদন্তের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে আগুনের ঘটনাটি তদারক করছেন। তিনি আরো বলেন, কীভাবে আগুন লেগেছে, কেন আগুন নেভাতে দেরি হয়েছে—তদন্ত করে আগুন লাগার কারণ খুঁজে বের করা হবে। আগুন লাগার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন সম্ভব হলে—এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা পরিষ্কার হবে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে এবং মেট্রো গ্রুপের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতাও বেরিয়ে আসবে।

উল্লেখ্য, মেট্রো গ্রুপের ওপর আনা অভিযোগকে একেবারে উড়িয়ে না দেওয়ারও যথেষ্ট কারণ আছে। এর আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কয়েকটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয় ১৮ তলা ভবন নির্মাণের এবং সে চুক্তিতে মালিকানার অংশ হিসেবে যা দেখানো হয়েছে তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথম চুক্তিতে সিটি করপোরেশনকে ২৭ শতাংশ এবং পরে তা বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছিল। ঢাকার বুকে গুলশান-১ এলাকায় এ রকম একটি বিশাল আয়তনের জমি অংশীদারিত্বে বণ্টন করাটায় কতটা নৈতিকতা রয়েছে, তা সব মহলেরই আজ জিজ্ঞাসা।

প্রশ্ন উঠেছে, কার স্বার্থ রক্ষা করে এই অসম বণ্টনটি করা হয়েছে এবং কারাই বা এর পেছনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ ধরনের চুক্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকার। ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। সরকার যে পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে—একইভাবে সেই পরিমাণ লাভবান হয়েছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি।

এ প্রসঙ্গে একই কথা উচ্চারিত হতে পারে। দীর্ঘ দশ বছর মার্কেটটিতে যারা ব্যবসা করে আসছেন, চুক্তিতে তাদের পুনর্বাসনের কোনো কথা বলা হয়নি। বহুতল ভবন নির্মিত হলে এই ব্যবসায়ীরা যাবেন কোথায়? এ ব্যাপারে যেন কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। এখানেই শেষ নয়। দোকান মালিকদের পক্ষ থেকে আদালতে চারটি মামলা করা হয়েছে। সে মামলা এখনো শেষ হয়নি। ঠিক এ রকম একটি সময়ে রাতের আঁধারে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ড।

যথাযথ কারণে মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দিতে পারে। তাই মেট্রো গ্রুপের দিকে একসঙ্গে সবার আঙুল উঠেছে। তারা বলছেন, গান পাউডার দিয়ে আগুন লাগানো হয়েছে। সে কারণেই আধা ঘণ্টার মধ্যে ভবনটি ধসে পড়েছে। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে।

ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন, প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসা দরকার এবং অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুবা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে, যা কখনো কারো কাম্য হতে পারে না।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নিরাপত্তা,ডিএনসিসি মার্কেট,অগ্নিকাণ্ড,ব্যবসা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist