আলমগীর খান

  ১২ জানুয়ারি, ২০১৭

শিশু, নাটক ও চঞ্চলের কথা

ক’দিন হলো আমার বন্ধু চঞ্চলের কথা মনে পড়ছে। কাগজে-কলমে সে ড. সাজেদুর রহমান। সে আমার অনেক দিনের পরিচিত হলেও তার সঙ্গে তেমন মেশা হতো না। তাই বলা যায়, অল্প দিনের বন্ধু। তবে খুব আন্তরিক, যদিও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে আমি পড়ি না। এক নাটকপাগল মানুষ। একসময় ঢাকায় টিএসসিকেন্দ্রিক একটি নাট্যদল করত। তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করে। পরে বাইরে থেকে নাটকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে অভিনয় ও নির্দেশনার জগতে ডুবে যায়। কিছুদিন টেলিভিশনে কাজ করে। ২০০৮ সালে ঢাকার একটি এনজিওর হয়ে সে গ্রামাঞ্চলে শিশুদের নিয়ে একটি নাটকের কাজে হাত দেয়। তখন তার সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ করতে হতো। দুর্যোগকে কেন্দ্র করে এই নাটকের মূল ধারণাটি তার তৈরি। তবে সংলাপসহ কাহিনির নানা অংশ গড়ে তোলে গ্রামের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, যারা কেউ কেউ অভাবের কারণে না খেয়ে বা আধপেট খেয়ে স্কুলে আসত। কুড়িগ্রামের ঠুটা পাইকড় স্কুলের কথা বলছি। ১৯০৪ সালে প্রাথমিক এবং ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি তিস্তার পারে অবস্থিত। চঞ্চলের নির্দেশনায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের তৈরি ওই নাটকটির নাম ছিল ‘সর্বনাশা তিস্তা’।

দিন-তারিখসহ এতদিন আগের এত কিছু আমার মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই সময় ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা কুরিয়ার’-এ প্রকাশিত আমার একটি লেখা থেকে এসব ঢেলে সাজাচ্ছি। চঞ্চল এতটা নাট্যপ্রেমিক এবং তার কাজের প্রতি এতটা মনোযোগী যে, সেখানে সে থাকার ভালো জায়গা না পেয়ে রাতে একা ওই স্কুলে থাকতে শুরু করে। মাঝেমধ্যে নাকি একটু ভয়ও করত। যাহোক, সেই বছর ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় ওই স্কুলের মাঠে হাজার তিনেক দর্শকের সামনে ৩০ জন ছেলেমেয়ে নাটকটি করে। অভিনয়ে তাদের একজন শিক্ষকও ছিলেন। পরদিন শহরে খলিলগঞ্জ স্কুলের প্রাঙ্গণে হাজার পাঁচেক দর্শকের সামনে আবার ওই নাটকটি করে তারা। পাঠক-পাঠিকার জন্য বলে রাখি, এই কাজটি ছিল ওই ৩০ জন ছেলেমেয়ের জন্য হিমালয়ের চূড়ায় ওঠার মতো। সেসব শিশুর সম্ভবত কেউই দেড় ঘণ্টার টেম্পো-রিকশার রাস্তা পাড়ি দিয়ে কোনোদিন কুড়িগ্রাম শহরে আসেনি। কোনোদিন মাইক্রোফোন ছুঁয়ে দেখেনি। পাঁচ হাজার দর্শকের সামনে অভিনয় তো দূরের কথা, ক্লাসে শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতেই তাদের হাত-পা কাঁপে। সেই দরিদ্র শিশুরা চঞ্চলের নেতৃত্বে ওই দুই দিন এ রকম প্রায় অসম্ভব একটা কাজ করল।

চঞ্চল আমাকে বলেছে, মহড়ার প্রথম দিকে এসব শিশুর অনেকে ভয়ে হাতটাও উঁচু করে কোমরের ওপর তুলতে পারত না। সংকোচে ছেলে ও মেয়ে পাশাপাশি বসতে পারত না। শুধু এটুকু হাসিল করতেই চঞ্চলকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। সেই ঘটনায় শিশুদের মতো একজন হয়ে তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার যে ক্ষমতা দেখেছিলাম, তা বিস্ময়কর। চঞ্চলের ব্যক্তিত্ব, নাটক ও শিশু একাকার হয়ে গিয়েছিল। ১৯ তারিখ সন্ধ্যার অনেক পরে নাটক ও দুর্যোগ মোকাবিলা নিয়ে অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়ার পর আমি আর চঞ্চল ঢাকায় ফিরব। শিশুরা তাদের শিক্ষকের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাবে। চঞ্চল যখন তার অল্পদিনের নাট্যশিক্ষার্থীদের বলল, ‘আমরা ঢাকায় ফিরে যাবো’, তখন প্রতিটি বাচ্চার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। চঞ্চলের নিজের কণ্ঠস্বরও কিছুটা কেঁপে উঠছিল। সে প্রত্যেক শিশুকে চকলেট কিনে দিল। অনেকক্ষণ শিশুরা তাদের আবেগ চেপে ধরে রেখেছিল, আর পারল না। হু হু করে কেঁদে উঠল কেউ কেউ। এই বাঁধভাঙা আবেগ ছড়িয়ে পড়ে অন্য শিশুদের মাঝে। আরও অনেকে কেঁদে ফেলল। মনে হয়, প্রত্যেক শিশুর চোখে তখন পানি।

আমি দুই দিন আগে ঢাকা থেকে গিয়েছিলাম। তাই আবেগাক্রান্ত হওয়ার কারণ ছিল না। তবু কেমন যেন কাতর হয়ে উঠলাম। মনে হচ্ছিল, সেসব শিশুর জীবনের প্রিয়তম মানুষটি অনেক দূরে চলে যাচ্ছে, যে মানুষটি তাদের অনেককে শুধু কোমরের ওপর হাত তোলা শেখায়নি, হাজার হাজার দর্শকের সামনে অভিনয় করা শিখিয়েছে। নাটকের মহড়ায় এসে তারা কয়েক দিন দুপুরে পেট ভরে খেতে পেয়েছে। তারা জীবনে প্রথম শহরে এসেছে। আর কোনোদিন এমন স্বপ্নরাজ্যের দেখা পাবে কি না তারা জানে না। চঞ্চল অবশ্য তাদেরকে বার বার আশ্বস্ত করছিল, সে আবার আসার চেষ্টা করবে। আর তাদেরকে সে ঢাকার অনুষ্ঠানে নিয়ে নাটক করাবে। অনিশ্চিত অবস্থায়ই সে এ কথাগুলো বলছিল। শিশুরা কেউ তাকে বিশ্বাস করেছিল কিনা জানি না, তবে সেসব শিশু আর কোনোদিন তাকে পায়নি। পাবেও না। চঞ্চল সম্প্রতি অনেক দূরে চলে গেছে—আকাশ জগতে। সেদিনের সেই শিশুরা আজ নিশ্চয়ই যুবক-যুবতী। তোমরা কেউ যদি এই লেখাটি পড়, তাহলে আরেকবার কেঁদে নাও।

এরপর চঞ্চলের সঙ্গে কালেভদ্রে যোগাযোগ হতো। একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে দেখা। নিয়ে গেল, যেখানে সে শিশুদের নাট্যচর্চা করাত। সে নিজেও ছিল শিশুর মতো সরল, তেমনি শিশুদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অপূর্ব ক্ষমতা ছিল তার। ঢাকায় গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের পর ফিল্ম, টেলিভিশন ও ডিজিটাল মিডিয়া বিভাগের প্রধান হয়ে একদিন সে ফোন করে। আসতে বলে, অনেক কথা আছে। গণমাধ্যমের নানাকিছু নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা থাকত, যা বাস্তবায়ন করা দুরূহ। এসব নিয়ে তার আলোচনায় উৎসাহের ভাটা ছিল না কখনও। সেখানে গিয়ে দেখা হলে সে আমাকে শিশু ও সভ্যতা নিয়ে তার একটি গদ্যের কথা বলে। আমি উৎসাহ দেখালে সে আমাকে সেটি ই-মেইলে পাঠায়, যা আমি আমাদের সংস্থার শিক্ষা বিষয়ক বুলেটিন ‘শিক্ষালোক’-এ (জুলাই ২০১৪) ছাপি। লেখাটি মূলত ইতালীয় শিক্ষাবিদ মারিয়া মন্তেসরির শিশুভাবনা নিয়ে রচিত। লেখাটি থেকে কয়েকটি অপূর্ব অংশ উদ্ধৃত করে এই লেখাটি শেষ করব, তার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বরূপ।

শুরুতেই আছে ড. মারিয়া মন্তেসরির ‘আপনার শিশু সম্পর্কে আপনার যা জানা উচিত’ (জ্ঞান প্রকাশম, অনুবাদ—অসিতবরণ ঘোষ) বই থেকে : ‘মানুষের ভোগ্যবস্তুগুলোই যদি শ্রমিক উৎপাদন করে এবং সে যদি সকল বাহ্য বস্তুর নির্মাতা হয়, তাহলে তো শিশু খোদ মানবজাতিকেই উৎপাদন করে। আর এ কারণেই সমাজ রূপান্তরের প্রশ্নে তার অধিকার প্রবলতর।’ বইটির আলোচনায় চঞ্চল লিখেছেন, ‘আমাদের বর্তমান অসভ্য সভ্যতা যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বা যাবে, তার কারণ, প্রথমত, এখনো শিশুর প্রকৃত মর্যাদা নিরূপণে ও প্রতিষ্ঠায় এটা আন্তরিক নয়। দ্বিতীয়ত, শিশুর মাধ্যমে প্রবাহিত মহাপ্রকৃতির নতুনতর মেসেজসমূহের প্রতি ক্ষীণদৃষ্টি দোষে দুষ্ট আত্মবিধ্বংসী বিষয়-বাসনায় আসক্ত তথাকথিত বয়োজ্যেষ্ঠ সমাজের সীমাহীন উদাসীনতা। শিশুকে দুর্বল, অসহায়, আদরের বস্তু আর অযোগ্য ভাবার একটা প্রবণতা তথাকথিত বয়ঃপ্রাপ্ত সমাজে লক্ষণীয়। শিশুর পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিসত্তার অবমাননা করে আমরা বয়ঃপ্রাপ্তরা কিন্তু প্রকারান্তরে নিজেদেরকেই অপমান করি।’

আরও লিখেছিলেন, ‘আমরা বয়স্ক কেজো সমাজ শিশুর মাধ্যমে আগত নিত্য নতুন সুসমাচারসমূহ অনুধাবনের চেষ্টা না করে বরং আমাদের জীর্ণ পুরাতন ধ্যান-ধারণা থেকে তাদেরকে পরিচালিত করি, শাসন করি, শোষণ করি, আদরের ছলে বিকৃত বাসনা চরিতার্থ করি এবং অভিভাবকত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের ওপর আমাদের পছন্দ-অপছন্দ চাপিয়ে দেই, আমাদের অপূর্ণ বাসনা সকল চরিতার্থে তাদেরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি। আমার সন্তান এবং ওর সন্তান-এ রকম স্থূল ও অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতার পাঁকে নিষ্পাপ-নিরপরাধ শিশুদেরকে টেনে নামাই। এভাবেই আমরা সামাজিক পরিবেশে পচন ধরাই এবং ধর্ষকামী ও কুসংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার ঘটাই। এমনটি করা আমাদের একেবারেই ঠিক না। এ ব্যাপারে কহলীল জীবরান-এর কাব্য স্মরণীয় : Your children are not your children/They are the son and daughter of future/They come through you but not from you.

আমাদের সমাজে এখন শিশুরা কেমন আছে, জানো চঞ্চল? সে কথা থাক। তোমার জন্য আল্লাহর দরবারে আমাদের দোয়া রইল।

লেখক : গবেষণা ও প্রকাশনা কর্মকর্তা, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস (সিদীপ)

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আলমগীর খান,শিশু,নাটক,চঞ্চল,অপরাধ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist