সাহাদাৎ রানা

  ২১ জুলাই, ২০২০

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর হোক

করোনা নামক এক অদৃশ্য ভাইরাস পৃথিবীর সব মানুষের জীবনযাত্রায় এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। করোনার প্রভাবে এরই মধ্যে অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়ে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। উপায় না দেখে অনেকে ফিরে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। ঢাকা মহানগরীর অলিগতিতে বাসাবাড়ির সামনে টু-লেট সংবলিত ছোট-বড় সাইনবোর্ড দেখলেই সংখ্যাটা প্রতীয়মান হয়। অথচ কিছুদিন আগেও যান্ত্রিক জীবনে নিজেদের অভিযোজিত করেই বাস করত মানুষ। এই বসবাসের নেপথ্যে কাজ করে নানামুখী তাগিদ। জীবিকার প্রয়োজন তো বটেই, নিজের কিংবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সোনালি দিনের প্রত্যাশায় উপেক্ষিত হয় যতেক ক্লেশ। সেজন্যই তো নিজের গ্রাম বা শহরের চিরচেনা পরিবেশ, স্বচ্ছন্দ আর প্রিয়জনদের স্নিগ্ধ উষ্ণতার হাতছানিকে পাশ কাটিয়ে অনেকে পথ ধরেন এই মহানগরীর কঠোর কঠিন জীবনের দিকে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজধানী ঢাকা দেশের অসংখ্য মানুষের প্রয়োজনের ঠিকানা। কিন্তু কখনো সেভাবে নিজের হয়ে ওঠে না। বেশির ভাগের পক্ষে সম্ভবও হয় না নিজের ঠিকানা করে নেওয়ার। এবার করোনা সেটাই প্রমাণ করল। করোনার কারণে বাধ্য হয়ে অনেকে প্রিয় রাজধানী ছাড়ছেন। বাড়িওয়ালা বাসাভাড়া কমানোর কথা বললেও তা শুনছেন না ভাড়াটিয়ারা। ফিরে যাচ্ছেন চিরচেনা ঠিকানায়। এর মধ্য দিয়ে আবারও নতুন করে বাড়িভাড়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তাহলে কি এত দিন ভাড়াটিয়াদের জিম্মি করে বাড়ির মালিকরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভাড়া আদায় করতেন?

জরিপ বলছে, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অথচ একই সময়ে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। পাশাপাশি রয়েছে নানা বিড়ম্বনা। বছর না ঘুরতেই বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া, বাড়ির মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী ভাড়াটিয়াকে বিনা নোটিসে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা, ভাড়া নেওয়ার সময় করা চুক্তির শর্ত না মানাসহ আছে নানা হয়রানি। অথচ ভাড়াটিয়াদের অজ্ঞতাকে এ ক্ষেত্রে খানিক দায়ী করা যেতে পারে। কারণ তারা অবগত নন, বাড়িভাড়া দেওয়া এবং নেওয়া সংক্রান্ত একটি আইন আছে দেশে। এমনকি বাড়িওয়ালারা হয় ওয়াকিবহাল নয়, না হয় থোড়াই কেয়ার করতেন এসব। ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’ নামের এই আইন সম্পর্কে অজ্ঞতায় স্পষ্ট হয় উভয়পক্ষের সচেতনতার অভাব। অবশ্য ইচ্ছা করে অমান্যের দলটাও কম ভারি নয়। অথচ ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’-এ বাড়িভাড়া সংক্রান্ত সমস্যা ও সমাধানের কথা বলা হয়েছে। আর এটা না জানার সুযোগটাই নিচ্ছেন বাড়িওয়ালারা। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা করছেন যথেচ্ছাচার।

সাধারণত আমাদের দেশে যারা বাড়িভাড়া দিয়ে থাকেন তারা সব সময় নিজেদের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি নিজের ষোলোআনা সুবিধাকে নিশ্চিত করতে চান। আর তা করতে গেলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কোনো অবকাশই তার থাকে না। সম্ভবও নয়। বাড়িভাড়া সংক্রান্ত অধ্যাদেশ প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। এরপর বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয় ১৯৯১ সালে। এই আইনে সুনির্দিষ্ট বেশ কিছু বিষয় রয়েছে বাড়িভাড়া দেওয়া এবং নেওয়ার ক্ষেত্রে। যেমন—আইন অনুযায়ী বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে একটি লিখিত চুক্তিনামা থাকতে হবে। যেখানে উভয়পক্ষের স্বাক্ষর থাকবে। আর সেই লিখিত চুক্তিতে উল্লেখ থাকবেচুক্তিনামায় ভাড়ার মেয়াদ, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, ভাড়ার পরিমাণ, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিলসহ অন্যান্য আরো নানা প্রয়োজনীয় বিষয় এবং এখানে স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল ও গ্যাস বিল কে পরিশোধ করবে। এ ছাড়া বাড়ির অবস্থান ও সৌন্দর্যের ওপর নির্ভর করে কত জামানত হবে, সেটাও এই লিখিত চুক্তিনামায় উল্লেখ থাকতে হবে। আর এই চুক্তিনামা অবশ্যই দলিল হিসেবে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে করতে হবে।

এবার ভাড়া পরিশোধের বিষয়টি : আমরা সাধারণত সরাসরি বাড়িওয়ালার হাতে ভাড়া দিয়ে দিই। এর বিনিময়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো রসিদ দেওয়া হয় না। কখনো আবার রসিদ দেওয়া হলেও সেখানে ভাড়ার পরিমাণ উল্লেখ থাকে না। অথচ ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’ অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে রসিদ বাধ্যতামূলক। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে আমরা এটা করি না। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত আরো একটি সমস্যার সম্মুখীন আমরা হয়ে থাকি; আর তা হলো- ভাড়া বৃদ্ধি। বাড়ির মালিক নানা অজুহাতে তার ইচ্ছামতো ভাড়া বৃদ্ধি করেন। যার শিকার ঢাকা মহানগরীর প্রায় প্রত্যেক ভাড়াটিয়া। বিশেষ করে নতুন বছরের শুরুতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আইনে স্পষ্ট রয়েছে, বাড়িওয়ালা চাইলেই ভাড়া বাড়াতে পারেন না। সাধারণত দুই বছরের কম সময়ে বাড়িভাড়া বাড়ানো যাবে না। এ সময়ের পর বাড়াতে হলে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে আপসে নির্ধারিত হবে। এ ভাড়া নিয়ন্ত্রকও নির্ধারণ করে দিতে পারেন।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অগ্রিম নেওয়া। ১৯৯১-এর ১০ ও ২৩ ধারা মোতাবেক বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনোভাবেই বাড়ির মালিক তার ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ এক মাসের বাড়িভাড়ার অধিক কোনো প্রকার ভাড়া, জামানত গ্রহণ করতে পারবেন না। এ ছাড়া এখানে আরো একটি বিষয় রয়েছে, যা আমরা অনেকে জানি না। সেটা হলো, বাড়ি মেরামত-সংক্রান্ত বিষয়ে। সাধারণত বাড়ি মেরামত করার দায়িত্ব বাড়িওয়ালাই নিয়ে থাকেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছু কিছু মেরামতের কাজ বাড়িওয়ালা করতে চান না। চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়ার ওপর; যা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। বাড়িওয়ালা চাইলেই ভাড়াটিয়াকে অন্যায়ভাবে বাসা থেকে বের করে দিতে পারেন না। এটাও চুক্তিনামার মধ্যে উল্লেখ থাকতে হবে। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া উভয়কে বাসা ছাড়ার কমপক্ষে দুই মাস আগে জানাতে হবে।

এ ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, চুক্তিনামা নবায়ন। মেয়াদ শেষে সেটা করা বাধ্যতামূলক। তবে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’ অনুযায়ী ২৫ হাজার টাকার বেশি ভাড়া হলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। তবে ট্যাক্স না দেওয়ার কারণে অনেকেই নগদে ভাড়া নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের জন্য ২০০৮ সালে সিটি করপোরেশন ঢাকা মহানগরীকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে সম্ভাব্য বাড়িভাড়ার তালিকা করে। কিন্তু বলা বাহুল্য, ঢাকার খুব কম বাড়িওয়ালাই তা অনুসরণ করে ভাটাটিয়াদের স্বস্তি নিশ্চিত করেছেন।

করোনার কারণে নতুন করে বাড়িভাড়ার বিষয়টি সামনে এসেছে। উঠেছে কিছু যৌক্তিক প্রশ্নও। তাই এর সমাধান হওয়াও জরুরি। বিশেষ করে এখন থেকে উভয়পক্ষের উচিত আইন মেনে চলা। ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’ মেনে চলা বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া উভয়ের জন্যই মঙ্গল। এতে করে বাড়ি মালিক ইচ্ছা করলেই স্বেচ্ছাচার করতে পারবেন না। সুরক্ষিত হবে ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ। পরোক্ষভাবে বাড়িওয়ালাও প্রশংসিত হবেন। তার স্বার্থও সুরক্ষিত থাকবে বৈকি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাড়িভাড়া,টু-লেট,রাজধানী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close