প্রকৌশলী মো. শামসুর রহমান
মুজিব শতবর্ষ ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন
আজ বহুল প্রত্যাশিত ১৭ মার্চ। চলতি বছরের এ দিনটি থেকে আগামী বছরের ২৬ মার্চব্যাপী উদযাপিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী তথা মুজিববর্ষ। পাশাপাশি ২০২১ সালে জাতি উদযাপন করতে যাচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বিষয়টি কাকতালীয়ভাবে আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। কেননা, বঙ্গবন্ধুর জীবন-যৌবন ও রক্তের ঋণের সঙ্গে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম ও প্রিয় মাতৃভূমির অস্তিত্ব বিশেষভাবে জড়িয়ে রয়েছে। একটি বাদ দিয়ে অন্যটি কল্পনা করার দুঃসাধ্য আমাদের নেই।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একটি অন্যটির পরিপূরকই নয়, বলতে হবে সমান্তরাল প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধু আজ সশরীরে আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু বাংলা, বাঙালির মর্যাদার সংগ্রামে বাংলার পথে-প্রান্তরে তার যে জীবন-যৌবন উৎসর্গিত হয়েছিল, শোষিত-বঞ্চিত অধিকারহারা মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে সেটি ছড়িয়ে রয়েছে বাংলার প্রতিটি পরতে পরতে। বাংলার প্রান্তরজুড়ে স্নিগ্ধ ধানখেত কিংবা কাশফুলের মাঠে বয়ে যাওয়া বাতাসের দোলাচল, নদীর কলতানি, সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মাঝে যে সুর বেজে উঠে, সেটাই বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের প্রতিধ্বনি। কোকিলের সমধুর কণ্ঠ কিংবা প্রান্তরজুড়ে গাঙচিলের কলতানের মাঝে সুরের যে ঝংকার, সেই তো বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের হুঙ্কার। অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির বাংলাদেশের এগিয়ে চলার যে অদম্য কর্মযজ্ঞ, এ যেন বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় পায়ে বাংলার পথে-প্রান্তরে ছুটে বেড়ানোর ব্যস্ততা। মহাকাশ কিংবা সমুদ্র জয় সবই যেন বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী জয়ের প্রতিচিত্র।
এ মহামানব সম্পর্কে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে জানতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখি নাই, শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ কী ছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বে! যা পরাধীন সাত কোটি মানুষকে ক্ষণিকে উত্তাল করে তুলত। বিশ্ব নেতৃত্বকে আকৃষ্ট করত! প্রকৃতি তার সুরে সুর তুলে বাংলার আকাশ-বাতাসকে কাঁপিয়ে তুলত! সেটি বর্তমান বা অনাগত প্রজন্মকে অবশ্যই জানতে হবে। সেই জানার ভেতর ঘাটতি থাকলে আমরা কথার ব্যঞ্জনায় ক্ষণিকে উদ্বেলিত হব, কিন্তু তা হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচার।
বঙ্গবন্ধুকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে জাগিয়ে রাখতে হলে শুধু কথার ব্যঞ্জনায় বঙ্গবন্ধু প্রেমিক হলে চলবে না, তার চিন্তা-চেতনা, ত্যাগ, মানুষের প্রতি মমত্ব-দায়বোধ, দেশপ্রেম অবশ্যই আমাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও কর্মের মাঝে ধারণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীন মাতৃভূমি ও আত্মপরিচয়ের ঠিকানা আমাদের জন্য রেখে গেছেন, সেটিকে তার কল্পিত চিত্রে অঙ্কিত করতে হলে আমাদেরও তার ত্যাগের মনোবৃত্তি ধারণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা হবে আমাদের সেই চর্চার প্রধান উপাদেয়।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বলতেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না এলে ভৌগোলিক স্বাধীনতা নিরর্থক হয়ে পড়ে। আর্থসামাজিক মুক্তির মাধ্যমে তিনি বাংলার মানুষকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুফল দিতে চেয়েছিলেন। কিছু সুবিধাভোগী মানুষের মাঝে সম্পদ ও স্বাধীনতার সুফলকে কুক্ষিগত না রেখে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য সম্পদের সুষম বণ্টন ও সম্পদ সৃষ্টি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষায় বিনিয়োগ, কৃষি ও শিক্ষার সংস্কার ও গণমুখী বাধ্যতামূলক সমবায় প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। যার মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে মাটি ও মানুষের সমন্বিত অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। জনগণের প্রতি তার মমত্ববোধের গভীরতা কী ছিল তা জানা যায় ১৯৭২ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে।
ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার শক্তি কোথায়। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিল, আমি আমার জনগণকে খুব ভালোবাসি। মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে। আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদের খুব বেশি ভালোবাসি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছেন, তা আমি সারাজীবন মনে রাখব। সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।
বঙ্গবন্ধু সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন, ভাবতেন। এই ন্যায়ভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র গঠনে তিনি সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয় বিভক্তি, স্বার্থান্ধতাকে প্রধান শত্রু হিসেবে ভাবতেন। তিনি অপকটে বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। ভুলে যেয়ো না। স্বাধীনতা পেয়েছো এক রকম শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে। তখন আমরা জানতাম আমাদের এক নম্বর শত্রু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও শোষকগোষ্ঠী। কিন্তু এখন শত্রুকে চেনাই কষ্টকর। যদি আমরা বিভক্ত হয়ে যাই এবং স্বার্থে দ্বন্দ্ব ও মতাদর্শের অনৈক্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে আত্মঘাতী সংঘাতে মেতে উঠি, তাহলে যারা এ দেশের মানুষের ভালো চান না ও এখানকার সম্পদের ওপর ভাগ বসাতে চান, তাদেরই সুবিধা হবে এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত, ভাগ্যাহত ও দুঃখী মানুষের মুক্তির দিনটি পিছিয়ে যাবে। তার এ উপদেশ আমাদের ধারণ করতে হবে, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য। তাই ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধু দিকদর্শনকে মনেপ্রাণে ধারণ করে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজটা করা হবে মুজিব শতবর্ষে তার প্রতি সুবিচার।
বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি তার কন্যা শেখ হাসিনা পিতার আদর্শ ধারণ করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তার দৃঢ় নেতৃত্বে বিশ্বে বাংলাদেশ আজ মর্যাদার আসনে আসীন। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ, যার জিডিপি আকার ২০১৯ সালে ৩১৭.৪৭৬৫ বিলিয়ন ডলার। বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এর ৯০ ভাগই বাস্তবায়ন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। আজ ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ও ৯৭ শতাংশ মানুষ উন্নত স্যানিটেশনের আওতায় এসেছে। ৮৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় রয়েছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও এসেছে যুগোপযোগী পরিবর্তন। সামাজিক নিরাপত্তা, গৃহদান, সর্বস্তরে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয়দান, বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০, সপ্তম ও পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্তকরণ, অষ্টম ও পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনার কাজ শুরু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, রূপপুর ২৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, মেট্রোরেল, কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণকাজ, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও নতুন ট্রেন চালু, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের সাহসী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়ার মতো উৎসাহ তিনি পেয়েছেন পিতার কাছ থেকে।
উন্নয়নের এ গতি ধরে রেখে আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর জন্মভূমি নির্মাণে আমাদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-দর্শনের কাছে প্রতিনিয়ত পৌঁছাতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়সা করতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনাও একই নীতি ধারণ করে এগিয়ে চলছেন। এগিয়ে চলার পথে আদর্শই জাতির মূল পুঁজি। পক্ষান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ আদায়ে লিপ্ত তারাও বঙ্গবন্ধুর ভাষায় এক ধরনের ভিক্ষুক, নীতিভ্রষ্ট রাজনৈতিক কর্মী।
এদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আগেই সতর্ক করেছেন— ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনো দিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ এর মর্মার্থ বুঝে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মুজিব শতবর্ষে চলনে-বলনে, কর্মে-চেতনায় আমাদের বদলে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। সময়ের চাহিদার যথার্থ মূল্যায়নে ব্যর্থ হলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় বর্তমান প্রজন্মকে জবাবদিহি করতে হবে। বিষয়টি অবশ্যই গভীরভাবে আমাদের ভাবতে হবে।
লেখক : প্রকৌশলী, সাধারণ সম্পাদক : আইডিইবি ও চেয়ারম্যান, এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
পিডিএসও/তাজ