জাকির আজাদ

  ০৪ মার্চ, ২০২০

শিশু থাকবে হাসিখুশি-আনন্দে

বরাবরই লক্ষ্য করেছে সুপ্রভাত বাবা তার কোনো আবদারই রক্ষা করেনি। বাবার কাছ থেকে বারবারই নিরাশ হতে হয়েছে তাকে। যখনি বাবা অফিসের কাজে ট্যুরে গেছে শহর ছেড়ে, সুপ্রভাত এটা-ওটার বায়না ধরে আনতে বলেছে, কখনো মোমে বসানো প্রজাপতি, চাবি দেওয়া পুতুল, লুডু খেলার সরঞ্জাম, ম্যাগনেটিক দাবার গুঁটি কিংবা প্রিয় কোনো খাবার; কিন্তু কোনোবারই বাবা তা নিয়ে আসেনি। অজুহাত দিয়েছে দোকান বন্ধ ছিল, সময় পাইনি কিংবা এটা পাওয়া যায়নি ইত্যাদি। তাছাড়া বাবার সঙ্গে শপিংয়ে গেলেও পছন্দমাফিক কোনো সময়েই কিছুই কিনতে পারেনি। জোর দাবি জানালে কেবলই বলেছে, পরে, পরে কিনো। বাবার সঙ্গে অনেকবারই সুপ্রভাত আড়ি পেতে থেকেছিল কিন্তু এতেও কোনো কাজ হয়নি। এনিয়ে সুপ্রভাতের মনে একটা দুঃখ-কষ্ট চেপে আছে। তার এই কষ্টের কথা ফুফুকেও জানিয়ে ছিল কিন্তু ফুফুও একই কথা প্রতিবারই বলেন, দেবে, অবশ্য কিনে দেবে, আজ দেয়নি তো কী হয়েছে, আরেক দিন দেবে। বাবার মতো মাটাও তার কেমন জানি। কেবল বাবার কথার সঙ্গে সায় মেলায়। ভালো লাগে না সুপ্রভাতের।

শরতের এক সুপ্রভাতে তার জন্ম হয়েছিল বলে কলেজ শিক্ষক দাদাজান রোজোয়ান মল্লিক তার নাম রেখেছিলেন সুপ্রভাত মল্লিক। জন্মের রেজিস্ট্রারি খাতায় জন্মের তারিখ অনুযায়ী বয়স উল্লেখ করা আছে ৮ বছর ৩ মাস। সুপ্রভাত কুমিল্লা শহরের ঝাউতলা এলাকায় ওয়াইডব্লিউ এমসি কিন্ডারগার্টেনের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। তবে স্কুলেও সে বাবার গল্প করতে পারে না। অথচ অন্যান্য মেয়েছেলে দিব্যি বাবার গল্প করে যায় অনর্গল। কারো বাবা এটা এনে দিয়েছে, কারো বাবা ওটা এনে দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি যত সব।

শিশুমাত্রই হাসিখুশি আর আনন্দে ভরপুর। তাদের চাহিদা সব সময়ই হাসিখুশিতে ডুবে যাওয়া। আর এর জন্য প্রত্যেক বাবা-মার উচিত হবে বিশেষ সচেতন হওয়া। কারণ বাবা-মা যদি বিমর্ষ মনমরা থাকেন; তবে এর প্রভাব শিশুর ওপর এসে পড়বেই। এবং যতসম্ভব পূরণ করতে হবে তার বায়না। বায়নাগুলো অযৌক্তিক হলে তাকে অত্যন্ত যুক্তিসহকারে বোঝাতে হবে। এমনতিইে আমাদের দেশের শিশুদের সারা বছরই পড়াশোনা পরীক্ষা লেগেই থাকে। পড়াশোনার বাঁধাধরা নিয়মটিও কিন্তু শিশুরা পছন্দ করে না। আর শিশুর পড়াশোনা পরীক্ষা নিয়ে মায়েদের ব্যস্ততারও কমতি নেই। তবু এরই মধ্য দিয়ে প্রত্যেক মা-বাবাকে সময় বেঁধে চলতে হবে। তাকেও সময় দিতে হবে। শুনতে হবে তার সব কথা। জানতে হবে তার অসুবিধার বিষয়গুলো।

অনেক সময় মনে করা হয়, ওরা ছোট বলে তাদের আত্মসম্মানবোধের হয়তো তেমন করে তৈরি হয়নি। কিন্তু সেই ধারণা একেবারে ভুল। আর এই ভুল ধারণার জন্যই অনেক সময় কী মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, তা হয়তো বুঝতে পারা যায় না। তাদের চাহিদাগুলো, বায়নাগুলো নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না ,শর্তারোপ করেই ক্ষান্ত হন অনেক বাবা-মাই। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা মেহতাব খানম শিশু-কিশোর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বলেন, বেশির ভাগেরই আত্মবিশ্বাসের বেশ অভাব লক্ষ করা যায়। এই জায়গা থেকে তাদের টেনে তোলার কাজটা করতে গিয়ে বোঝা যায়, কত দৃঢ়ভাবে এই আস্থাহীনতা তাদের গ্রাস করেছে।

অনেক বাবা-মাই তার শিশুকে ঘরের চার দেয়ালের ভেতর বন্দি করে রাখতে চান। শুধু স্কুলের সময়টুকু ছাড়া বাইরে বেরোতে দিতে চান না। যার ফলে সে হয়ে পড়ে ঘরকুনো স্বভাবের। তাই শিশুর মিশুক মনমানসিকতা গড়ে তুলতে তাকে বাইরে অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে। ঘরে যতক্ষণ শিশু থাকে; ততক্ষণ তার সঙ্গে হাসিখুশিতে মেতে থাকা উচিত। জগতখ্যাত সাইকোথেরাপিস্ট কার্ল রজার্স তার তত্ত্ব দিতে গিয়ে বলেছেন, একটি সুস্থ সত্তা তৈরি হওয়ার পেছনে যা দরকার তা হচ্ছে, ভালোবাসা, মমতা, উষ্ণতা, শ্রদ্ধা, যত্ন এবং গ্রহণযোগ্যতা। কিন্তু দেখা যায়, ছেলেবেলায় এমনকি বড় হওয়ার পরও মানুষ বাবা-মা এবং বড়দের কাছ থেকে যা পায়, তা হচ্ছে শর্তারোপিত ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা।

কার্ল রজার্স তার তত্ত্বে খুব দৃঢ়ভাবে বলেছেন, শর্তহীন ভালোবাসার কথা। পিতা-মাতার সঙ্গে শিশুর প্রথম সম্পর্ক তৈরি হয় এবং এ সম্পর্ক কতটুকু সহজ ও দৃঢ় হবে, তা নির্ভর করে শিশু তার বাবা-মায়ের কাছে শর্তহীন ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে কিবা তার ওপর। যে শর্তহীন ভালোবাসা শিশুর মনের নিরাপত্তাহীনতা, মূল্যহীনতা দূর করে তার মধ্যে ভিত গড়ে ইতিবাচক আত্মমর্যাদাবোধ। তাই বাবা-মাকে পরিত্যাগ করতে হবে চাহিদা পূরণের শর্তসাপেক্ষ মনোভাব। কারণ চাহিদা পূরণের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে করতে শিশুদের ভেতর নিজের প্রতি আস্থা কমে যেতে থাকে। তাদের ধারণা, জন্মাতে থাকে তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন বড়দের কর্তৃক নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছতে না পারা পর্যন্ত কোনো স্বীকৃতি নেই। নিজেদের এই মূল্যহীন ভাবার কারণে তাদের আবেগীয় ও আচরণগত বিকাশ ব্যাহত হয়।

শিশুর পরিবেশের একটা প্রধান দিক হচ্ছে মানসিক ও সামাজিক পরিবেশ। গৃহের পরিবেশ হওয়া উচিত হাসিখুশি আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। অভিভাবক হিসেবে পরিবারের অন্যান্য সদস্য, কাজের লোকটির প্রতি কিরূপ ব্যবহার করছেন, তার ওপর নির্ভর করবে শিশুর ব্যবহার। শিশুর থেকে যে রকম ব্যবহার আশা করবে; সে রকম ব্যবহার দেখাতে হবে। শিশুদের দুর্বল দিকগুলোর ওপর চোখ না ফেলে তাদের সাফল্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। শিশুর স্বাস্থ্য নির্ভর করে সুষম আহার ও পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের ওপর। স্কুল থেকে গৃহে ফিরে অধিকাংশ শিশুকে পড়তে বসা, নয়তো কোচিংয়ে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। বিনোদন বলতে টিভি দেখা কিংবা কম্পিউটার গেম। টেলিভিশন ভিডিও এবং কম্পিউটার গেমস নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য বেঁধে দেওয়া দরকার। কী ধরনের অনুষ্ঠান শিশুরা টিভিতে দেখত তার ওপর নজর রাখতে হবে। আজকাল শিশুদের মধ্যে হিংস্রতা সৃষ্টির প্রধান কারণ হচ্ছে টেলিভিশন। শিশুর প্রতিদিন খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করা উচিত এবং সেই সুযোগ না থাকলে অন্তত এক্সারসাইজ করা উচিত। এক্সারসাইজ সুস্থ রাখে এবং মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে। তাছাড়া প্রত্যেক বাবা-মায়েদের উচিত কমপক্ষে সপ্তাহে শিশুকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাওয়া। জাদুঘর, স্মৃতিসৌধ, চিড়িয়াখানা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এমনকি আরো দর্শনীয় স্থানগুলো শিশুদের দেখাতে হবে। মাঝে মাঝে স্টেডিয়ামে নিয়ে শিশুকে সরাসরি খেলা দর্শন করাতে হবে। এতে শিশুর মনে খেলার প্রতি আগ্রহ জন্মাবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই শিশুদের ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। শিশুদের সেখানে নিয়ে গিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাবা-মায়ের সাধ্যের বাইরে শিশুরা যখন কোনো কিছু দাবি করে বসে, তখন অবশ্যই ধৈর্যের সঙ্গে বিষয়টি তাকে বোঝাতে হবে। আর যদি কেউ শর্তারোপ করতেই চান, তাহলে তাকে বুঝতে হবে শিশুরা যে আবদারগুলো করছে সেটার জন্য এমন কোনো শর্ত দেওয়া, যেটা শিশুর পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। তবে যদি কোনো কারণে সে তা অর্জনে ব্যর্থ হয়; তাহলে তার অন্য কোনো ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সেই আবদারটি রক্ষা করা যেতে পারে। আদর, ভালোবাসা, স্নেহ, বাৎসল্য প্রয়োগ করে সাধ্য অনুসারে শিশুদের সাধ পূরণ করতে হবে। তবে যথাসাধ্য হাসিখুশি আনন্দে ভরিয়ে রাখতে হবে তাদের। শিশুর প্রতি নজর রাখার মানে হওয়া উচিত পৃথিবীকে নিজের জটিল দৃষ্টিতে না দেখে শিশুর সহজ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ। যতই শিশুর মতো বেশি জানার সচেষ্ট হব, ততই ভালো বাবা-মা হওয়ার সুযোগ ঘটবে। শিশু কেবল আনন্দের বিষয়ই নয়, তার মাঝেই বেঁচে থাকে পরবর্তী প্রজন্ম।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শিশু,আনন্দ,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close