রায়হান আহমেদ তপাদার

  ৩০ জানুয়ারি, ২০২০

মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা এবং...

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে ড্রোন (চালকবিহীন বিমান) হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ইরানের প্রভাবশালী সামরিক কমান্ডার সোলাইমানিকে। এরপরই রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা বাড়ার ওই সতর্কবার্তা দিয়েছে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর এলিট কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়াবে বলে জানিয়েছে রাশিয়া। সোলাইমানির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে বড় ধরনের সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ মার্কিন হামলার ঘটনাকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিয়েছেন। এ ঘটনার ভয়ংকর প্রতিশোধ নেওয়ারও হুমকি এরই মধ্যে দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি।

ওদিকে পেন্টাগন সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য দিয়ে বলেছে, ইরানের ভবিষ্যৎ হামলা পরিকল্পনা ঠেকাতেই হামলা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তাদের স্বার্থ এবং জনগণকে রক্ষায় সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে যাবে। বহু মার্কিন সেনা নিহতের ঘটনা এবং মধ্যপ্রাচ্যে অনেক প্রাণহানির জন্যও পেন্টাগন সোলাইমানিকে দায়ী করেছে। ফলে সোলাইমানি নিহতের ঘটনাটি কেবল ইরাকের জন্যই নয়, সামগ্রিক মধ্যপ্রাচ্যের জন্যই বড় টার্নিং পয়েন্ট হতে চলেছে। পুরো অঞ্চলে ঘনিয়ে আসতে চলেছে ছদ্মযুদ্ধের এক নতুন অধ্যায়।

মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সব দেশেই যে এ ঘটনার প্রভাব পড়বে, তা এক রকম নিশ্চিত। সবাই এখন ইরান কী করে, তা দেখার অপেক্ষায় আছে। ইরানে ১৯৭৯ সালের পর এত বড় ধরনের এবং এত দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহতভাবে আন্দোলনের কোনো ইতিহাস নেই, যদিও প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের বিক্ষোভ এবং আন্দোলন হয়েছে। ইতোমধ্যে বিক্ষোভের স্লোগান উঠেছে, স্বৈরাচার নিপাত যাক। এমনকি ইরানে যা কল্পনার বাইরে ছিল খামেনির দিকেও বিক্ষোভকারীরা আঙুল তুলছেন। ইতোমধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ, যিনি রেভল্যুশনারি গার্ডসের অ্যারোস্পেস কমান্ডার, এ ঘটনার জন্য দায় স্বীকার করেছেন। ফলে সরকার এ ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়েই এখনকার এই বিক্ষোভ সাময়িকভাবে প্রশমন করতে পারছে কি না, তা দেখার বিষয়। কিন্তু বিক্ষোভের প্রকৃত কারণগুলো উত্তরোত্তর আরো ব্যাপক রূপ লাভ করবে। দেশে ইতোমধ্যেই বেকারত্বের হার ১৭ শতাংশের কাছাকাছি, তরুণদের মধ্যে এ হার ২৮ শতাংশের বেশি। ইরানের সরকারি পরিসংখ্যান কেন্দ্রের পরিচালক অমিদ আলো পারসি ২০১৯ সালের শুরুতে বলেছিলেন যে, ইরানের গ্র্যাজুয়েট তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ৪০ শতাংশ। লক্ষ করলেই দেখতে পাওয়া যায় যে, নভেম্বর এবং গত কয়েক দিনের বিক্ষোভের অগ্রভাগে আছেন এই তরুণরাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে সেøাগান উঠছে।

সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বেই নিন্দিত হচ্ছিল এবং বৈশ্বিকভাবে ইরানের প্রতি সহানুভূতির মাত্রাই ছিল বেশি; ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের প্রতীকী হামলায় প্রাণনাশ না হওয়ায় এবং এই হামলার ব্যাপারে ইরাককে আগে থেকেই জানানোর কারণে সেই সহানুভূতি বড় রকমের হ্রাস হয়নি। সেই সুযোগে ইরান একটি বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলেও আলোচনায় ততটা আসেনি। সেটি হচ্ছে, ইরান ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে এসেছে, ইরান বলেছে ওই চুক্তির আওতায় পারমাণবিক কর্মসূচিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, মজুদ, গবেষণা বা উন্নয়ন সীমিত রাখার যেসব শর্ত ছিল, সেগুলো তারা মেনে চলবে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এরপর ইউরোপের দেশগুলোকে এই চুক্তি থেকে সরে আসার জন্য আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করছিল না। কিন্তু বিমান বিধ্বংসের ঘটনা এবং তা অস্বীকারের চেষ্টা ইউরোপ এবং কানাডার কাছে ইরানের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই হ্রাস করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোববার তেহরানে বিক্ষোভ চলার সময়ে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতকে সাময়িকভাবে আটকের ঘটনা। ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত রব ম্যাককেয়ারকে আটক করার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, তিনি প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। সরকারি ভাষ্য হচ্ছে যে, তাকে না চিনেই বিদেশি বলে আটক করা হয়েছিল।

কূটনীতিকরা বলছেন, নতুন সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে ইরান ও তার মিত্রদের সামরিকভাবে মোকাবিলা করার ক্রমবর্ধমান সৌদি আকাক্সক্ষা। এক বছর আগে বাদশাহ সালমান সৌদি আরবের ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে এই আকাক্সক্ষার শুরু। নিজ দেশে পর্দার অন্তরালের রাজনীতি বন্ধে বাদশাহ সালমান তার ছেলে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমানকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। গত বছর রিয়াদ ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের দমনে কয়েকটি দেশকে নিয়ে বিমান হামলা শুরু করেছে। সিরিয়ায় তেহরানের মিত্র প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরোধীদেরও সমর্থন দিচ্ছে রিয়াদ। মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ঘিরে শিয়া নেতা নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদন্ড সৌদি আরব কার্যকর করলেও সেটি ইরানের সঙ্গে তার প্রকাশ্য বিরোধের একটি অংশ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

রিয়াদ কয়েক বছর ধরেই অভিযোগ করছে, ইরান সৌদিসহ আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। এটা ক্রমে বাড়ছেই। এই অভিযোগের ধারাবাহিকতায় সৌদি আরবে শিয়া নেতা নিমরের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার ঘটনা ঘটল। সৌদি আরব এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে, এই অঞ্চলের শিয়া বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে ইরান। সৌদির অভিযোগ, উপসাগরীয় দেশগুলোতে শিয়া বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্রও সরবরাহ করছে তারা। তবে ইরান এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে নমনীয় না হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবায়ের রয়টার্সকে বলেন, ইরানকে এই অঞ্চলে আমরা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে দেব না। আমরা ইরানকে আমাদের বা আমাদের মিত্রদের নাগরিকদের ক্ষতি করতে দেব না। এর ব্যতিক্রম হলে জবাব দেওয়া হবে।

মধ্যপ্রাচ্যে এক বছর ধরেই যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করে আসছিলেন অনেকেই। তবে সব পক্ষই বলে আসছিল তারা যুদ্ধ এড়াতে চায়। কিন্তু এবার মার্কিন হামলায় ইরানি জেনারেল নিহতের যে বিস্ফোরক ঘটনা ঘটল, তা পুরোপুরি পাল্টে দিল মধ্যপ্রাচ্যের প্রেক্ষাপট। মধ্যপ্রাচ্যকে ঠেলে দিল পুরোপুরি একটি ভিন্ন এবং বিপজ্জনক সংকটের দিকে। বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর এলিট কুদস ফোর্সের নিহত কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানির জায়গায় এরই মধ্যে তার উপপ্রধান কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল ঘানিকে নিয়োগ করেছে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব প্রতিপত্তি সোলাইমানির সময় যেমন ছিল, এখন নতুন কমান্ডারের অধীনেও তা একই থাকবে বলে এক বিবৃতিতে ঘোষণা দিয়েছেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি।

ওদিকে, সোলাইমানির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানের রাস্তায় এরই মধ্যে দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছে বিক্ষোভ। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিরুদ্ধে রাজধানী তেহরানের রাস্তায় নেমেছে লাখো মানুষ। কারণ, জেনারেল সোলাইমানি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঘোর প্রতিপক্ষ হলেও ইরানিদের কাছে ছিলেন খুবই প্রিয়। কুদস ফোর্সের প্রধান হিসেবে ইরাক, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে ইরানের বাড়তে থাকা সামরিক প্রভাবের কারিগর ছিলেন তিনি। প্রায় ২০ বছর কুদস ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছেন সোলাইমানি। সামরিক শক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, মিত্রদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা এবং ইরাকে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় জঙ্গিগোষ্ঠীর একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করা ছাড়াও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী ভূমিকা ছিল সোলাইমানির। তাকে হত্যা করা ইরানিদের কাছে যুদ্ধেরই শামিল এবং এর প্রতিশোধ না নিয়ে তারা ক্ষ্যান্ত হবে না।

সোলাইমানি হামলার পরিণতি কী হতে পারে, তা এখনো বোঝা না গেলেও ইরান পাল্টা জবাবে কোথায় কোথায় আঘাত হানতে পারে, তা কিছুটা আঁচ করা যায়। তাদের একটি সম্ভাব্য লক্ষ্যস্থল হতে পারে সিরিয়ায় ছোট মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো। সেখানে কোথাও কোথাও এ ঘাঁটিগুলো ইরাকি পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিটের কয়েক মাইলের মধ্যেই অবস্থিত। সিরিয়া থেকে অনেক মার্কিন সেনা চলে গিয়ে সেখানে সেনা উপস্থিতি এমনিতেই কমে এসেছে। ফলে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র এখন সামরিক শক্তিতে অনেকটাই দুর্বল। সিরিয়া ছাড়াও উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো বিশেষ করে বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব ইরানের প্রতিশোধ হামলার শিকার হতে পারে। একই ঝুঁকিতে আছে কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেইদ ঘাঁটি। যদিও বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ইরানের ক্ষোভ যত গভীরই হোক, তারা প্রতিশোধ হিসেবে এখনই যুদ্ধ শুরু করবে বলে মনে হয় না। তবে তারা মার্কিন বিভিন্ন বাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানিমূলক নানা পদক্ষেপ নিতে পারে। আর সে কারণেই সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কন্টিনজেন্টগুলো ইরানি হামলার শিকার হতে পারে। এবারও তেহরানে হামলার শিকার হলো সৌদি আরবের দূতাবাস। ইরানের আরেক শহরে সৌদি কনস্যুলেটেও চালানো হয়েছে হামলা। কারণ, সৌদি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছে সে দেশের অন্যতম শিয়া ধর্মীয় নেতা নিমর আল-নিমরের। সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। বের করে দিয়েছে ইরানি দূতাবাসের কর্মীদের। নতুন করে এসব ঘটনা সৌদি-ইরান দীর্ঘদিনের উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের সমাধানও তুলেছে জটিল করে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মধ্যপ্রাচ্য,শান্তি আলোচনা,সোলাইমানি হত্যা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close