ইসমাইল মাহমুদ

  ২৪ জানুয়ারি, ২০২০

জাতির জনকের সাংবাদিক জীবন

স্বাধীনতার মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন—এমন কথা শুনলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো অবাকই হবেন। অনেকেই হয়তো ভাববেন, বাল্যকাল থেকেই সমাজের কল্যাণকর কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করা, রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা ও সাজানো মামলায় জীবনের অধিকাংশ সময় পাক সরকারের কারাগারে আটক থাকা জাতির জনকের পক্ষে সাংবাদিকতা করার মতো সময় ও সুযোগ কোথায়? কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সব সময়ই একটা নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তিনি নিজেও রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অন্য সব দায়িত্বের পাশাপাশি সাংবাদিকতার মতো মহান দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি যেমন দেশের মানুষের কল্যাণে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন; তেমনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুুষের সেবায় সব সময়ই ব্রত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের নানাদিক বর্তমান প্রজন্মের জানা থাকলেও তার জীবনে সাংবাদিকতা জীবন ও সংবাদপত্রের সঙ্গে আত্মিক স¤পর্কের কথা অনেকেরই অজানা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটি অনেকটা আড়ালেই রয়ে গেছে।

আমরা যদি জাতির জনকের ব্যক্তিজীবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো সেসময়ের কবি, লেখক ও সাহিত্যিকরা যে ধরনের পোশাক পরিধান করতেন, তার পোশাকও ছিল অনেকটা সে ধরনের। চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা, কালো রঙের মুজিব কোটের ওপর কাঁঠালচাপা রঙের চাদর জড়ানো, মুখে পুরোনো ধুমপানের পাইপ ছিল তার প্রায় সর্ব সময়ের সাথী। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেও তিনি এ ধরনের পোশাক পরিধান করতেন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জননন্দিত নেতা হয়েও তার চলাফেরা, পোশাক-আশাকের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক হাসান শান্তনুর লেখা ‘সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু’ বইটিতে সাংবাদিক-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমী রাষ্ট্রনায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাংবাদিকতা জীবনের নানা উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে।

রাজনীতি নামের মহাকাব্যের মহানায়ক ৫৫ হাজার বর্গমাইল আয়তনের আমাদের এ দেশটার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিতদের অধিকার আদায়, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জন বা সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নানাভাবে পত্রিকা প্রকাশ করে গেছেন। তিনি সরাসরি সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় সম্পৃক্ত ছিলেন। সংবাদপত্র জগতে তিনি ছিলেন কখনো মালিক, কখনো সাংবাদিক, কখনো পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি, কখনো পরিবেশক, কখনো উৎসাহদাতা, কখনো সাহসের বাতিঘর, কখনো উদ্যোক্তা, প্রেরণা, আদর্শ ও অভিভাবক।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রচিত বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবণী’তে উল্লেখ রয়েছে, ‘দৈনিক আজাদই ছিল একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান রক্ষা আন্দোলনের সমর্থন করত। এ কাগজের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন বাংলা ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি আবুল হাশিমকে দেখতে পারতেন না। আবুল হাশিম শহীদ সাহেব সমর্থন করতেন বলে মওলানা সাহেব তার উপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমাদেরও ওই একই দশা। তাই আমাদের কোনো সংবাদ সহজে ছাপা হতো না। মাঝে মাঝে মোহাম্মদ মোদাব্বের সাহেবের মারফতে কিছু সংবাদ উঠত। পরে সিরাজুদ্দিন হোসেন (বর্তমানে ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক) এবং আরো দু-একজন বন্ধু আজাদ অফিসে চাকরি করতেন। তারা ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা সংবাদ ছাপাত। দৈনিক মনিং নিউজের কথা বাদই দিলাম। ওই পত্রিকা যদিও পাকিস্তান আন্দোলনের পরোপুরি সমর্থন করত, তবু ওটা গোষ্ঠীর স¤পত্তি ছিল, যাদের শোষক শ্রেণি বলা যায়। আমাদের সংবাদ দিতেই চাইত না। ওই পত্রিকা হাশিমকে সমর্থন করত, তাই বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে সংবাদ দিত। আমরা বুঝতে পারলাম, অন্ততপক্ষে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ হলেও আমাদের বের করতে হবে। বিশেষ করে কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবধারা প্রচার করার জন্য। হাশিম কাগজ বের করা কষ্টকর। কারণ টাকা-পয়সার অভাব। শহীদ সাহেব হাইকোর্টে ওকালাতি করতে শুরু করেছেন। তিনি যথেষ্ট উপার্জন করতেন, ভালো ব্যারিস্টার হিসেবে কলকাতায় নাম ছিল। কলকাতায় গরিবরাও যেমন শহীদ সাহেবকে ভালোবাসতেন, মুসলমান ধনকশ্রেণিকেও শহীদ যা বলতেন, শুনতেন। টাকা-পয়সার দরকার হলে কোনো দিন অসুবিধা হতে দেখিনি। হাশিম শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রকাশ করতে এবং বললেন যে, একবার যে খরচ লাগে তা পেলে পরে জোগাড় করতে অসুবিধা হবে না। নুুরুদ্দিন ও আমি এই দুজনই শহীদকে রাজি করাতে পারব, এই ধারণা অনেকেরই ছিল। আমরা দুজনই এক দিন সময় ঠিক করে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে অনেক ভালো ভালো লেখার হাত আছে, যারা সামান্য হাত খরচ পেলেই কাজ করবেন। অনেককে কিছু না দিলেও চলবে। আরো দু-একবার দেখা করার পরে শহীদ রাজি হলেন। মুসলিম লীগ অফিসের নিচতলায় খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম নিজেই সম্পাদক হবেন এবং কাগজ বের করা হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারি করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসই কাগজের লেখা ছাপার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসেবেও তার যথেষ্ট নাম ছিল। ব্যবহারও ছিল অমায়িক। পুরো বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিল। তারা কাগজ চালাতে শুরু করল। বুদ্ধিজীবী সমাজে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল মিল্লাত।

বঙ্গবন্ধু তার বইয়ে উল্লেখ করেন, মানিক ভাই তখন কলকাতায় ইত্তেহাদ কাগজের সেক্রেটারি ছিলেন। আমাদের টাকা-পয়সার খুবই প্রয়োজন, কে দেবে? বাড়ি থেকে লেখাপড়ার খরচা কোনোমতে আনতে পারি; কিন্তু রাজনীতি করার টাকা কোথায় পাওয়া যাবে? আমার একটু সচ্ছল অবস্থা ছিল, কারণ আমি ইত্তেহাদ কাগজের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলাম। মাসে প্রায় ৩০০ টাকা পেতাম। আমার কাজ ছিল এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করা, আর ইত্তেহাদ কাগজ যাতে চলে এবং নতুন এজেন্ট বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ করা যায়, সেটা দেখা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার ২৩ বছরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ, দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইত্তেফাক, নতুন দিন, স্বদেশ ইত্যাদি পত্রিকা বা গণমাধ্যমে কাজ করেছেন; যা জাতির জনকের বর্ণালি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ অধ্যায়টি বাঙালির ইতিহাসের জন্যও বিশেষ অধ্যায়। এ অধ্যায় গণমাধ্যমের ইতিহাসের জন্য গৌরবময় ও মর্যাদার।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সাংবাদিক,জাতির জনক,বঙ্গবন্ধু
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close