আবু আফজাল সালেহ

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২০

অনিরাপদ ঢাকা শহর

‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)’-এর ‘সেইফ সিটি ইনডেক্স (এসসিআই)’-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহরের তালিকায় নিচের দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সূচকে ঢাকা খুবই বাজে অবস্থানে রয়েছে।

এ শহরে চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নানা অনিয়ম বিরাজমান। চিকিৎসাক্ষেত্রে নানা অসংগতি। ‘ব্যবসা ব্যবসা’ মনোভাবই বেশি। বেকারত্বের হারও বাড়ছে। গণমাধ্যমে জানা যায় যে, গত বছর বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। যানজট, বস্তি, চুরি, ছিনতাই বেড়েই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। পরমতসহিষ্ণুতা নেই-ই। ফলে এ শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দা হতাশাতে ভুগে থাকে। ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)’-এর এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকার প্রায় ৭১ শতাংশ বাসিন্দা বিভিন্ন কারণে বিষণ্ণতায় ভুগছে এবং ৬৮ শতাংশ মানুষ শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত। এ শহরের ৩ শতাংশ (প্রায় সাড়ে সাত লাখ) বাসিন্দা তিনবেলা খেতে পায় না। এ সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।

গত বছরের জানুয়ারিতে ডেমরার নুসরাত জাহান (৪)ও ফারিয়া দোলা (৫) নামে দুই শিশুকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করা হয়। বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার সমাপ্ত হয়নি। সাংবাদিক দম্পতির সাগর-রুনির হত্যার কূলকিনারা আজও পাওয়া যায়নি। বারবার পিছিয়ে যায় বিচারের তারিখ। এসব বিষয়ে আরো একটু সতর্ক ও নিরপেক্ষ হতে হবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের সহায়তা করতে হবে। কিন্তু উভয়পক্ষই ব্যর্থ হচ্ছে। ধর্ষিতাদের একাংশের আত্মহননের ঘটনাও কম নয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এ ক্ষেত্রে বেশি দায়ী।

ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীকেই অপরাধী হিসেবে দেখা হয়। সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয় এ দুঃস্মৃতি। অপমান সহ্য করতে না পেরে বা বিচার না পেয়ে ভুক্তভোগীর পাশাপাশি অনেক অভিভাবকও আত্মহত্যা করে থাকে এ দেশে, এ শহরে। বড়ই মর্মান্তিক এ দৃশ্য! বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবিচার, ক্ষমতার অপব্যবহার চরমভাবে দায়ী। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এ শহর বা দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হয়। ঢাবির সঙ্গে সাধারণ কলেজের অবস্থানে পার্থক্য অনেক। আবার সাধারণ কলেজের চেয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার হয় বেশি। সাধারণের ক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ গল্পের মতো, ‘ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পল্লীতে...’ এর মতো অবস্থা। এ দেশে জাস্টিসও স্থান, কাল ও পাত্রভেদ আছে! শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়।

বাস থেকে নামার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েটিকে জোর করে ধর্ষণ করা হয়েছে। মেয়েটি সাংস্কৃতিককর্মী এবং ঢাবির ছাত্রী বলেই প্রতিবাদটা হয়েছে তাৎক্ষণিক এবং বেশি। সারা দেশে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। তার মধ্যে কিছু কিছু ভিআইপি ঘটনা (!) জেগে ওঠে। অন্যগুলো আড়ালেই থেকে যায়। আরেকটা বিষয় হলো, ‘সিলেক্টিভ জাস্টিস’। ‘অমুক করলে শাস্তি হবে, অমুক করলে হবে না’— এমন ধারণা থেকেও সমাজে বাড়ে অপরাধপ্রবণতা। এ রকম বৈষম্য মানসিকতা দূর করতে বা বাসিন্দাদের মধ্যে আস্থা আনতে প্রথমে সরকারের সংস্থাগুলোকেই দায়িত্ব নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তো এসব বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়ে যাচ্ছেন। তাকে সহযোগিতা আমাদেরই করতে হবে। সব জায়গায় কিছু খারাপ মানুষ থাকবেই। এসব শনাক্ত করেই বা এড়িয়ে চলেই ভালো কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবেই। ঢাকা বা দেশবাসীকে আস্থা আনতে বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।

অবিচার ও অনাচার রুখতে গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের চাপ বাড়াতে হবে। আমরা দেখেছি, টাঙ্গাইলের রূপাহত্যার পর মাত্র ১৪ কর্মদিবসে এবং ফেনীর নুসরাত রাফি হত্যার বিচার ৬১ কর্মদিবসের মধ্যে আসামিদের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। নুসরাত হত্যায় গণমাধ্যমের কঠোর অবস্থানের প্রশংসাও করেছিলেন আদালত। তবে অজানা কারণে তনু হত্যার বিচার স¤পন্ন হয়নি। প্রবল চাপে কুর্মিটোলায় ঢাবি ছাত্রীর ধর্ষক ‘সিরিয়াল র‌্যাপিস্ট’কে অল্প সময়েই গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রায় একই সময়ে ঢাবিতে চা-বিক্রেতা মামার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ের বিচার চেয়ে প্রায় একাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বর্ষাকালে একটু কম থাকলেও গ্রীষ্ম ও শীতকালে অনেক দূষিত থাকে বায়ু। দিনে বা রাতে সব সময়ই বাতাসে অনিরাপদ জিনিসে ভরপুর। ধুলোবালিতে ভরপুর। নিয়নবাতি কেড়ে নিয়েছে ঢাকার স্নেহ-ভালোবাসা। বিজ্ঞাপনে ছারখার ঢাকা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালে এটা দ্বিগুণ হয়ে ৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার ৫০০ মানুষ বাস করে। ঘনবসতির দিক দিয়ে বিশ্বে শীর্ষে অবস্থানে করছে আমাদের ঢাকা। ঢাকা শহরের উন্নয়ন কর্মকান্ডের ওপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগরীতে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশই পুরোপুরি অপরিকল্পিত। এর জন্য সাধারণ বাসিন্দারাও কম দায়ী নয়।

আমরা আইন না মানার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হয়ে গেছি। নারী ও শিশু নির্যাতনে অনিরাপদ শহরের তালিকায় শীর্ষের দিকেই রয়েছে ঢাকা শহর। প্রতারণা ও ছলচাতুরী ঢাকা শহরে অনেক বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যার যার ক্ষমতার মোহ বা আর্থিক মোহে একে অপরকে ঠকিয়েই যাচ্ছি। ঢাকা শহরে গত বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ। ২০১৮ সালেও বেড়েছিল ছয় শতাংশ। ক্রমান্বয়ে এ শহরের বাসিন্দাদের ব্যয় বাড়ছে। অবিচার ও বৈষম্য অপরাধীর সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

এদিকে সরকার চায় জনগণের মঙ্গলকর কিছু। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পারে না। এ ক্ষেত্রে আমরাও দায়ী। আমরাও সরকারকে ঠিকমতো সহযোগিতা করি না। সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোকে সহযোগিতা করি না। এ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে আমাদের। ‘আইন না মানার’ প্রবণতাও আছে আমাদের। এ ক্ষেত্রেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ দায়ী। আমরা শুধু নিজেরটাই বুঝে নিতে চাই বা বুঝতে চাই। তাই সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা শুধু সরকারের পক্ষে করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। জনসচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমকে আরো বেশি অবদান রাখতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঢাকা,অনিরাপদ,ধর্ষণ,ঢাকার পরিবেশ,নিরাপত্তা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close