পঞ্চানন মল্লিক

  ০৪ অক্টোবর, ২০১৯

শারদীয় দুর্গোৎসব ও ধর্মীয় সম্প্রীতি

হিন্দুধর্মের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা বছর ঘুরে আবার সমাগত হলো। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এ পূজার জন্য সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। মায়ের শ্রীচরণ স্পর্শ লাভে ব্যাকুল হয় ভক্তের মন। তাই ভক্তের মঙ্গল কামনায় কাক্সিক্ষত শুভক্ষণে মা পতিগৃহ কৈলাশ ছেড়ে পিতৃগৃহ বসুন্ধরায় আসেন। আনন্দে মুখরিত হয় চারদিক। বাজে মঙ্গল ঘণ্টা। ভক্তের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মা পা রাখেন এ মর্ত্য ধামে। সঙ্গে আসেন ছেলে-মেয়ে গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী।

এ আগমন এবং পরবর্তীতে প্রস্থানে একেক বছর একেক বাহন হয় মায়ের। কখনো তিনি আসেন গজে, কখনো ঘটক, কখনো নৌকা আবার কখনো দোলায় চড়ে। আবার ফিরে যান ঠিক এই চার বাহনের যেকোনো একটিতে করে। এই বাহনেই নির্ধারণ হয় মর্ত্যবাসী জীবের এক বছরের শুভ-অশুভ, ভালো-মন্দ। মহালয়ার দিনই সূচনা হয় মায়ের আগমনী পর্বের। ওইদিন মন্দিরে মন্দিরে চন্ডীপাঠের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

এদিন থেকে দেবী পক্ষ এবং দুর্গাপূজার ক্ষণগণনা শুরু। এদিন দেব-দেবীকূল পূজার জন্য নিজেদের জাগ্রত করে। ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের শুরু। মারকেন্দীয় পুরান মতে, চেদী রাজ বংশের রাজা সুরাথা খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িশায়) দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। ত্রেতা যুগে লঙ্কার রাজা বারণ সীতাকে হরণ করলে তাকে উদ্ধারের জন্য ব্রক্ষ্মার পরামর্শে রামচন্দ্র প্রথম শরৎকালে দেবীর পূজা করেন। এ পূজা ‘অকাল বোধন’ বা শারদীয় দুর্গাপূজা নামে পরিচিত।

উৎসব ও পার্বনের দেশ বাংলাদেশ। এখানে বসবাসরত মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের নিজ নিজ ধর্মের রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে বছরের বিভিন্ন সময় নানা ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকেন। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, খ্রিস্টানদের শুভ বড়দিন, স্টার সানডে ইত্যাদি, বৌদ্ধদের বুদ্ধপূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা ইত্যাদি, হিন্দুদের তেমনি দুর্গোৎসব, দোলপূর্ণিমা, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি। এদের মধ্যে দুর্গোৎসব হচ্ছে হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসব প্রতি বছর ষাড়ম্বরে প্রতিপালিত হয়ে থাকে।

এ দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর ধর্মীয় বিভিন্ন বিধিবিধান, আচার ও অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে এটি উদ্যাপন করে থাকে। এর মধ্যে থাকে মহালয়ার দিন প্রভাতে চন্ডীপাঠ, ষষ্ঠিতে বোধন ও পূজা, সপ্তমীতে সপ্তমী বিহিত পূজা, অষ্টমীতে অষ্টমী বিহিত পূজা ও কুমারী পূজা, নবমী ও দশমীতে পূজা এবং পূজা শেষে দশমীতে বিসর্জন। পূজা উপলক্ষে ধর্মীয় আলোচনা সভা, পূজা অন্তে প্রসাদ বিতরণ, চন্ডীপাঠ, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় যাত্রাপালা বা নাটক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়।

মূল অনুষ্ঠানটি হয় নিজ নিজ মন্দিরে। এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে হাজারো লোকের সমন্বয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাসহকারে বরণ কূলা নিয়ে যাওয়া হয়। বিনিময় হয় পরস্পর কুশলাদি। হরেক রকম বাহারি পর্দায়, ধর্মীয় ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডে বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয় মন্দির প্রাঙ্গণ। প্রতিদিন পূজা শেষে পুষ্প, বিল্বপত্র, তুলশীপত্র সহোযোগে অঞ্জলী প্রদানের ব্যবস্থা থাকে। এতে অংশ নেন সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ-বনিতা, নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ। পূজা অঙ্গন মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। সেখানে বিরাজ করে আনন্দমুখর পরিবেশ।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় মায়ের আরতি বরণ। মানুষ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পাশাপাশি নির্মল আনন্দেও মেতে ওঠে। ধর্মীয় আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকেন হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতসহ এলাকার গণ্যমান্য জনপ্রতিনিধিরা। ধর্মীয় অনুভূতির পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যের তাগিদও তাদের আলোচনার মধ্যে ফুটে ওঠে। ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন রেডিও, টেলিভিশনের খ্যাতনামা সংগীত শিল্পীরা। এদের মধ্যে অনেক বাউলশিল্পীও থাকেন। তারা গেরুয়া পোশাকে বাউল সেজে লোকসম্মুখে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করেন।

বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শারদীয় দুর্গোৎসব নির্বিঘেœ শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকেন। সার্বিক শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসন সহযোগিতা করে। আর্থিক অনুদান প্রদানসহ সরকার অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকতাও দান করে। পূজা উপলক্ষে দশমীর দিন সরকারি ছুটি থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকেরা যুগ যুগ ধরে সম্প্রতি ও সৌহার্দের মধ্য দিয়ে পরস্পর মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। তাদের পরস্পরের মধ্যে যেমন রয়েছে হৃদ্যতা, আন্তরিকতা তেমনি অপর ধর্মের প্রতিও রয়েছে গভীর শ্রদ্ধাবোধ। এক ধর্মের অনুষ্ঠানে অন্য ধর্মের লোকজন অংশগ্রহণ করেন। এ জন্য বলা হয় ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশ।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজায় এর ব্যত্যয় ঘটে না। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতির অনেকখানি জুড়ে রয়েছে এই শারদীয় দুর্গোৎসব। পূজার সময় কেউ কেউ সারা দিন উপোস থাকেন। পূজা শেষে অঞ্জল প্রদানের মধ্য দিয়ে উপোস ভাঙেন। পূজার ৫ দিন সকলে মিলে অংশ নেন অনুষ্ঠানে। দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণ কামনায় মন্দিরে মন্দিরে চলে প্রার্থনা। সব মিলিয়ে এ দেশের মানুষের পারস্পরিক সৌহার্দ বোধ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও দেশের সার্বিক পরিবেশ এখানকার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গোৎসব প্রতিপালনে অনুপ্রাণিত করে। ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে সৌহার্দের মেলবন্ধন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে এসব ধর্মীয় উৎসব।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শারদীয়,শারদীয় দুর্গোৎসব,শারদীয় দুর্গাপূজা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close