ইসমাইল মাহমুদ

  ০১ অক্টোবর, ২০১৯

বিশ্ব প্রবীণ দিবস

বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক শেষ আশ্রয়স্থল

আজ ১ অক্টোবর বিশ্ব বয়োজ্যেষ্ঠ বা আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। রাষ্ট্রসংঘ বার্ধক্যকে মানবজীবনের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে এ সমস্যা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করে আসছে। রাষ্ট্রসংঘ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব এবং উন্নত বিশ্বের জন্য ৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সি ব্যক্তিদের প্রবীণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

শত বছর আগে সমাজে বয়স্ক বা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক অনেক কম। সমাজে যারা প্রবীণ বা বয়োজ্যেষ্ঠ হতেন, তারা পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে যথেষ্ট মর্যাদা পেতেন। আজ থেকে প্রায় শত বছর আগের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ১৯২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ২০ বছর। আজ প্রায় শত বছর পর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় ৭২.৩ বছর।

সরকারি হিসাব অনুয়ায়ী, বাংলাদেশে এখন ১ কোটি ৪০ লাখ প্রবীণ ব্যক্তি রয়েছেন। যাদের বয়স ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব। ২০০২ সালে জাতিসংঘ সম্মেলনে ১৫৯টি দেশ অংশগ্রহণ করে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে একটি দলিল তৈরি করেছিল।

একটা সময় প্রবীণ বা বয়োজ্যেষ্ঠরা পরিবারে-সমাজে যথেষ্ট মর্যাদাবান হলেও অর্ধশত বছর ধরে কিছুসংখ্যক প্রবীণ পরিবারে-সমাজে অবহেলার শিকার হয়ে আসছেন। ওই প্রেক্ষাপটে প্রবীণদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়েছিল। বিশ্বের অধিকাংশ বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছিল তীর্থস্থানকে কেন্দ্র্র করে। প্রবীণদের একটি বড় অংশ ভিক্ষাবৃত্তি, অপরের করুণা, দয়া, অনুদান গ্রহণ করে জীবন বাঁচিয়ে রেখেছেন। তবে প্রবীণদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য কিছু মানুষ এগিয়ে আসেন।

বাংলাদেশের খতিব জাহিদ মুকুল অসহায় প্রবীণদের শেষ জীবনটা যেন কষ্টের না হয়; সেজন্য কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা, ত্যাগ আর সাধনায় গড়ে তুলেছেন উপমহাদেশের বৃহত্তম ‘বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’। রাজধানীর উত্তরা থানার আজমপুরে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি চালু হয় ১৯৮৭ সালে। পরে এটি গাজীপুরে ৭৫ বিঘা জমির ওপর স্থানান্তর করা হয়।

বিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি, সচেতনতা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন হওয়ায় মৃত্যুহার অনেক হ্রাস পেয়েছে। বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি) এ প্রতিবেদন বর্তমান বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষের আয়ু ৭০ দশমিক ৮ বছর আর নারী ৭৩ দশমিক ৮ বছর।

ফলে পুরুষের থেকে নারীরা গড়ে তিন বছর বেশি বাঁচে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৭২ বছর, ২০১৬ সালে ছিল ৭১ দশমিক ৬ বছর, ২০১৫ সালে ছিল ৭০ দশমিক ৯ বছর, ২০১৪ সালে ছিল ৭০ দশমিক ৭ বছর, ২০১৩ সালে ছিল ৭০ দশমিক ৪ বছর, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৬ দশমিক ৮ বছর। দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়াছে বলেই বাড়ছে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা।

বয়োজ্যেষ্ঠ বা প্রবীণদের সম্মান করা আমাদের আবশ্যিক দায়িত্ব। প্রতিটি মানুষ প্রবীণদের সম্মান করা শেখে নিজের পরিবার থেকেই। কোনো শিশু যদি কোনো গুরুজন বা প্রবীণের সঙ্গে রেগে কথা বলে তখন ওই শিশুর বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে শেখানো ‘গুরুজনদের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে নেই।’ কোনো কোনো পরিবারের শিক্ষা হলো, ‘উনি বয়স্ক, উনাকে সম্মান করে কথা বলবে।’

এসব শিক্ষা পরিবারের বড় ছেলে বা মেয়ে গ্রহণ করে মা-বাবার কাছ থেকে, ছোট ভাই-বোনেরা এ শিক্ষা গ্রহণ করে বড় ভাই-বোনদের কাছ থেকে। এ শিক্ষাই হলো সমঝদার প্রতিটি বাঙালি পরিবারের শত শত বছরের ঐতিহ্য এবং সভ্যতা। তবে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এর ব্যতিক্রম চোখে পড়ে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে শহুরে কথিত আধুনিক পরিবারের অধিকাংশ বয়োজ্যেষ্ঠের মৃত্যুর আগের সময়টা পার করতে হয় অত্যন্ত জটিল ও কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে। আধুনিক পরিবারের অধিকাংশ বয়োজ্যেষ্ঠ বা প্রবীণ ব্যক্তির দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আর্থিক সব ক্ষেত্রেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। যদি কেউ এ ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি হন; তবে তারা তাদের চরম ধৈর্য, মানসিক শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় পরিবার ও সমাজে। যে বাবা-মা তাদের জীবন-যৌবন জলাঞ্জলি দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেন; সে বাবা-মা অনেক পরিবারেই বৃদ্ধ বয়সে হয়ে পড়েন অচ্যুত।

অনেক পরিবারে এমনও শোনা যায়, বৃদ্ধ মানুষ পরিবারের বোঝা! আধুনিক শহুরে জীবন ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার অলীক কল্পনার নামান্তর। কখনো কখনো দেখা যায়, বাবা-মা বা পরিবার যে সন্তানকে মানুষ করতে সর্বস্ব ত্যাগ স্বীকার করেছেন; পরবর্তীতে সেই সন্তানরাই যখন তাদের নিজেদের সংসার গড়ার দায়িত্বে নিয়োজিত হন; তখন তারা ভুলে যান তাদের বাবা-মায়ের কর্মক্ষমতা, সহনশীলতা ও ত্যাগের অবদান। অনেক পরিবার বাবা-মার অবদান ভুলে গিয়ে বৃদ্ধাবস্থায় তাদেরকে পরিবারের বোঝা মনে করে। এতে সন্তানদের দ্বারা বাবা-মা বা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা দুর্ব্যবহার ও নির্মমতার শিকার হন।

কিছুদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এক পরিবারের ৬ সন্তান বিসিএস ক্যাডার। অথচ তাদের মা রাস্তায় ভিক্ষে করেন। সন্তানরা কেউই বৃদ্ধা মায়ের দায়িত্ব নিতে চান না। অপর এক সংবাদে দেখতে পাই, ৭৫ বছরের বৃদ্ধ বাবার ৩ কোটি টাকার সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে ছেলে বাবাকে অসুস্থ অবস্থায় রেলওয়ে স্টেশনে ফেলে রেখে যান।

বয়োবৃদ্ধ বা প্রবীণদের ওপর চলমান নির্মমতা রোধ করতে সমাজসচেতন সবাইকেই চিন্তা করতে হবে এখনই। বয়োবৃদ্ধদের স্বল্প সময়ের জীবনটা যাতে নিগৃহীত আর অপমানের না হয়; সে লক্ষ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সমাজসচেতনদের নিয়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পদক্ষেপ গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি দেশের প্রতিটি শিশুকে এখন থেকেই নৈতিক ও মানসিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে। ইসলাম ধর্মে আছে ‘মুরব্বির দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন।’ প্রতিটি পরিবারের সন্তানকে শিশুকালেই ধর্মীয় শিক্ষাও দিতে হবে। এতে সন্তানরা বাল্যকাল থেকেই বাবা-মার প্রতি সহনশীলতার শিক্ষা লাভ করবে এবং নিজ কর্তব্যে সজাগ হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে সংসারজীবনে প্রত্যেক বাবা-মা নিঃস্বার্থ হৃদয়ে, সব দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা ভুলে অদম্য উৎসাহে নিজ গর্ভজাত-ওরসজাত সন্তান লালন-পালনে অভূতপূর্ব দায়িত্ব পালন করেন। সংসারে সচ্চলতা আনয়নে বাবা-মার নিত্যদিন কাটে তাদের কর্মব্যস্ততায়। একটা সময় তাদের এ কর্মচঞ্চলতায় ভাটা পড়ে এবং জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তারা উপনীত হন। পরিবারে তখন তারা হয়ে ওঠেন অযোগ্য ও বোঝা আর সমাজে অবাঞ্ছিত। এ সময়টাতেই বয়োজ্যেষ্ঠদের অধিক পরিমাণে মানসিক ও শারীরিক নিগৃহীত হতে দেখা যায়। এসব রোধে সমাজসচেতন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে।

সমাজে প্রবীণদের গুরুত্বের কথা মনে রেখে আমাদের সবার উচিত তাদের প্রতি সহমর্মী হওয়া এবং তাদের সমস্যা বুঝে পাশে দাঁড়ানো। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে সেটাই হোক আমাদের একমাত্র ব্রত ও অঙ্গীকার।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

Email : [email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিশ্ব প্রবীণ দিবস,বয়োবৃদ্ধ,বৃদ্ধাশ্রম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close