শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার

  ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পর্যটন শিল্পে অফুরন্ত সম্ভাবনার কক্সবাজারে অন্তহীন সমস্যা

পৃথিবীর ভাগ্যবান শহরের তালিকায় কক্সবাজার। যার বুক চিরে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। প্রতি বছর এখানে দেশি বিদেশি পর্যটকের ঢল নামে। তারা সাগরের লোনা জলে গা ভাসায়। নিয়ে যায় কিছু স্মৃতি আর রেখে যায় কিছু মুহূর্ত। দীর্ঘতম সৈকত, পাহাড়-ঝর্না আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি কক্সবাজারে এতকিছু থাকার পরেও যেন অনেক কিছু অপূর্ণ থেকে যায় পর্যটকদের কাছে।

পর্যটন সম্ভাবনার এই কক্সবাজারে অফুরন্ত সম্ভাবনা যেমন আছে, ঠিক তেমনি পর্যটন শিল্পে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার দৈন্য দশা, অপরিকল্পিত নগরায়ন আর কংক্রিটের ঝঞ্জালের এই শহর থেকে পর্যটক বিমূখ হচ্ছে দিনদিন। সঠিক পরিচালনা আর পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে বছরের পর বছর অবহেলিত হয়ে আছে বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত আর কক্সবাজারের দর্শনীয় স্পটগুলো। পাশাপাশি সৈকত দখল আর সমুদ্র দূষণের কবলে পড়ে সৌন্দর্য হারাচ্ছে সমুদ্র সৈকত।

সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে যত্রতত্র বহুতল ভবন গড়ে উঠায় পর্যটন শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলীন হওয়ার পথে। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হলেও এখনও এ কর্তৃপক্ষ পুরোদমে তাদের দায়িত্ব শুরু করতে পারেনি। প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র গড়ে উঠছে ভবন। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে সৈকতসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে স্থাপনা।

সংশ্লিষ্ট মহলের অভিমত, বিভিন্ন সরকারের আমলে পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে একাধিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রকল্পগুলোর কিছু আলোর মুখ দেখলেও অধিকাংশ সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হয়নি। তবে পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য কক্সবাজারে যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তাতেই বিশ্বের দরবারে এ শহরকে পরিচিত করতে এবং সরকারের রাজস্ব খাতে বিশাল অঙ্কের অর্থ জোগান দিতে ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। আরও কিছু উল্লে­খযোগ্য উন্নয়ন হলে এ শিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা উন্মুক্ত হবে।

পর্যটন শহর কক্সবাজারের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন উপ-সড়কের বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। খানাখন্দে ভরে গেছে সড়কগুলো। পর্যটন স্পটগুলোসহ সৈকতপাড়ে নির্মিত তারকা মানের হোটেল-মোটেলগুলোর সামনে এমন কিছু রাস্তা রয়েছে যা দেখলে কখনও মনে হবে না এটি পর্যটন শহরের রাস্তা। কলাতলি ডলফিন মোড় শহরের প্রবেশদ্বার, হাশেমিয়া মাদ্রাসাস্থ পৌরসভা গেইটের প্রবেশদ্বারে ময়লার ভাগাড় জানান দেয়, এই শহর কতটুকু স্বাস্থ্যকর? কলাতলিসহ আশপাশের তারকা মানের হোটেল-মোটেলের পাশে নালা-ডোবা, ময়লা-আবর্জনা ভর্তি ডাস্টবিন পর্যটন শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। শহরের অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেল-মোটেল ও কটেজ গড়ে উঠলেও কোনো হোটেলে নেই বর্জ্য এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ফলে ময়লা-আবর্জনা রাস্তার ওপর এসে জমা হয়। ময়লার উৎকট গন্ধে বিষিয়ে তুলে পরিবেশ। এখানে এমন কিছু আবাসিক হোটেলের গলি আছে যেখানে দুর্গন্ধে চলাচল করা দায়। এ বেহাল অবস্থার জন্য যেমন কক্সবাজার পৌরকর্তৃপক্ষ দায়ী, ঠিক তেমনি দায় এড়াতে পারবে না হোটেল মালিক কর্তৃপক্ষও।

সৈকতপাড়ের লাবণী ও সী-ইন পয়েন্টের মাঝামাঝি হোটেল সী-গালের সামনের প্রধান রাস্তাটির অবস্থা নাজুক। প্রতি বছর বর্ষা এলেই এ রাস্তার চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না। সাগরের মতো বৃষ্টির পানি ঢেউ খেলে এ রাস্তায়।

সরজমিনে দেখা গেছে, ভিআইপি রোড খ্যাত শহীদ সরণী, জাম্বুর মোড় থেকে কলাতলি ডলফিন মোড় পর্যন্ত সড়ক, হলিডে মোড় থেকে বাজারঘাটা-লারপাড়া বাসটার্মিনাল পর্যন্ত সড়ক, হাসপাতাল সড়কসহ শহরের আরো অসংখ্য উপ-সড়কের অবস্থা অত্যন্ত করুন। সড়ক ভেঙে খানা খন্দে ভরে যাওয়ায় যান ও জন চলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে।

এদিকে, কক্সবাজার পর্যটন শহরের হলিডে মোড় থেকে বাজারঘাটা-লারপাড়া বাসটার্মিনাল পর্যন্ত প্রধান সড়কের সংস্কার কাজ দ্বিতীয় দফায় শুরু করেছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে: কর্ণেল (অব:) ফোরকান আহম্মদ জানান, পর্যটন শহরের জিরো পয়েন্ট হলিডে মোড় থেকে বাজারঘাটা-লারপাড়া (বাসটার্মিনাল) পর্যন্ত প্রধান সড়কের সংস্কারসহ প্রশস্তকরণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পটি একনেকের সভায় অনুমোদন লাভ করেছে। শিগগির উক্ত প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে সড়কের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাওয়া গত ৩ ও ৪ আগস্ট সড়কের সংস্কার কাজ করা হয়েছিল। কিন্তু অতি বৃষ্টির কারণে উক্ত সড়কের কিছু অংশ ভেঙে যায়। এতে করে আবারও সংস্কার কাজ করা হচ্ছে।

কউক চেয়ারম্যান কর্ণেল ফোরকান আরও বলেন, সড়ক সংস্কারের জন্য বর্তমানে কোনও বরাদ্দ না থাকলেও জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে।

এ শহরে প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক আগমনের এ সুযোগের অপব্যবহার করেন রিকশা, টমটম ও সিএনজি অটোরিকশা চালকরা। তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করেন। নানা অজুহাতে হয়রানি করেন পর্যটকদের। বিদেশি পর্যটকরা বেশি সমস্যায় পড়েন। অনেক অসাধু চালক পর্যটকদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেন এমন অভিযোগও শোনা যায়।

জেলার অধিকাংশ পর্যটন স্পট কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে। সৈকতের বিভিন্ন স্পটে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের শতশত ঝুপড়ি বসতঘর। এ বসতঘরগুলো নির্মাণে প্রতিনিয়তই কাটা হচ্ছে ঝাউগাছ। পাশাপাশি ভাসমানদের ঝুপড়ির কারণে একদিকে যেমন পরিবেশের চরম বিপর্যয় ঘটছে, তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলীন হচ্ছে। ওইসব ঝুপড়িতে পতিতা ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নানান অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রভাবশালীদের দখলদারিত্বের কারণে সৈকতের সৌন্দর্য বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ছোট হয়ে আসছে পর্যটন স্পটের পরিসরও।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি ফরিদ উদ্দিন খন্দকার বলেন, শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো থাকার কারণে বড় ধরনের কোনও অঘটন ঘটে না। এলাকার আম জনতা ও পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে মামলায় অভিযুক্ত ও চিহিৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে নেমে পর্যটকের মৃত্যুর তালিকা দিনদিন দীর্ঘ হচ্ছে। গত ১০ বছরে সমুদ্রে গোসল করতে নেমে স্থানীয় ও পর্যটকসহ প্রায় ৩৬৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সমুদ্রে সী নেটিং স্থাপনসহ সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার ফখরুল ইসলাম বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ সার্বক্ষনিক টহলে থাকেন। সৈকতে গোসলের সময় ভেসে যাওয়া লোকজন উদ্ধার কাজে লাইফগার্ড কর্মী ও ডুবুরি নিয়োজিত আছেন। পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে সৈকতে চলাফেরা করতে পারছেন।

সমস্যার পাশাপাশি বিশ্বের দীর্ঘতম এ সমুদ্র সৈকতসহ কক্সবাজারকে ঘিরে পর্যটনশিল্পের অফুরন্ত সম্ভাবনাও রয়েছে। যদি সরকার সম্ভাবনাগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে তাহলে কক্সবাজার জেলা থেকে উল্লে­খযোগ্য রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর। এলক্ষ্যে তিনি সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশনাও দিয়েছেন ইতোপূর্বে। যার প্রমাণ অতি অল্প সময়ের মধ্যে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ফুটবল কমপ্লেক্সের কাজ শুরু করার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। সঠিক সময়ে যদি এ দুটি স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক মানে প্রস্তুত করে নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করা যায় তাহলে দেশীয় মুদ্রার পাশাপাশি বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব হবে।

এছাড়াও কক্সবাজার পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেললাইন ও কেবল ওয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দোহাজারি থেকে কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর ও রেললাইনের কাজ ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়েছে। কক্সবাজার- চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করার সিদ্ধান্ত আছে। এসব সিদ্ধান্ত ও প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজারে সহজ যোগাযোগ পর্যটক বাড়াবে বহুগুন। পাশাপাশি এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন ও ‘কেবল চেয়ার‘ প্রকল্প আলোর মুখ দেখলে পর্যটন শিল্প বিশ্বের দরবারে অনেকদূর এগিয়ে যাবে।

পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কক্সবাজার সৈকত, পাথুরে বিচ ইনানী, হিমছড়ির পাহাড়ি ঝর্না, প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, সোনাদিয়া দ্বীপ, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, শহরের বৌদ্ধ মন্দিরসহ জেলার পর্যটন স্পটগুলোর সৌন্দর্যবর্ধন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করলে পর্যটনবান্ধব নগরীতে পরিণত হবে কক্সবাজার। দেশি বিদেশি পর্যটক আগমন বাড়বে, সেই সাথে সরকারও পাবে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পর্যটন,কক্সবাজার,সম্ভাবনা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close