প্রফেসর ড. এম শাহ নওয়াজ আলি

  ২১ আগস্ট, ২০১৯

একুশে আগস্ট ট্র্যাজেডি ও শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগের নেতারা সেদিন শেখ হাসিনার চারপাশে ঘিরে মানবঢাল তৈরি করেন

আগস্ট ২১, সাল ২০০৪। দিনটি ছিল শনিবার। সরকারের কাছ থেকে জনসভা করার জন্য মুক্তাঙ্গন কিংবা পল্টন ময়দান ব্যবহারের অনুমতি না পেয়ে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি বড় ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহারের জন্য সাজানো হয়। বেলা ১টা থেকে দূর-দূরান্ত হতে হাজার হাজার নেতাকর্মী সমাবেশে হাজির হতে থাকেন। বিকাল ৫টায় সমাবেশস্থলে আসেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে শেখ হাসিনা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তার বক্তব্যে শেষ করে ট্রাক মঞ্চ থেকে নিচে নামার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাকে হাত দিয়ে নামতে সাহায্য করছিলেন আইভি রহমান। ঠিক তখনই ঘাতক হায়েনারা আক্রমণ শুরু করে। মুহূর্তেই ঘটে যায় নারকীয় তাণ্ডব।

গাঙ্গেয় অববাহিকার পলল-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় রচিত হয় এক ঘৃণিত অধ্যায়। রক্তের বন্যা আর মানুষের চিৎকার আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। নির্মম ও পৈশাচিক গ্রেনেড হামলায় ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে প্রাণ হারান ২৪ জন। যারা নিহত হয়েছেন তারা আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না—এ কথা ধ্রুব তারার মতো সত্য। তবে ওই ঘটনায় শত শত নেতাকর্মী স্প্লিন্টার ও বুলেটবৃদ্ধ হয়ে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনছেন কিংবা ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। তাদের কান্না, তাদের আকুতি আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনার সমগ্র জীবনই একটি অলৌকিক ইতিহাস। যা বিশ্বের এক বিরল মহাকাব্য। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দেশের বাইরে প্রবাস জীবন। অবর্ণনীয় দুঃখ, কষ্ট ও স্বজন হারানোর আকুতি নিয়ে কেটে যায় ছয়টি বছর। ১৯৮১ সালে দেশের টানে, দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। এরপর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাসে রচিত হতে থাকে নতুন ইতিহাস। শেখ হাসিনার জীবনে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। স্বৈরাচার এরশাদ কিংবা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব তথা গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারে নিরন্তর চেষ্টা চালাতে গিয়ে তিনি বহুবার হামলার শিকার হয়েছেন, ঘাতকদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন! কিন্তু গণতন্ত্রের মানসকন্যা হয়ে সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক নিয়মে তিনি আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন।

১৯৮১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অসংখ্যবার ঘাতকদের হত্যাচেষ্টাকে পরাজিত করে কখনো রাষ্ট্রনায়ক, কখনোবা বিরোধীদলীয় নেত্রী আবার কখনো রাজপথের প্রতিবাদী কান্ডারি হয়ে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এ কথা স্বীকার করতেই হবে ঘাতকদের হিংস্র থাবা থেকে, স্বাধীনতাবিরোধীদের হামলা থেকে, মৌলবাদী ও জঙ্গিদের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা থেকে একাধিকবার বেঁচে গিয়ে শেখ হাসিনা আজ ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দারিদ্র্যমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে ছুটে চলেছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাটুরিয়া। তার শরীরে বইছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সৎ, সংগ্রামী, প্রতিবাদী এবং দেশপ্রেমের রক্তের ধারা।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনার জীবনে একটি রক্তাক্ত দিন। স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের সমাবেশে যাওয়ার প্রাক্কালে এরশাদের মদদপুষ্ট তৎকালীন পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে গুলিতে প্রাণ হারান ৪০ জন নেতাকর্মী। শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি করলেও ৪০ নেতাকর্মীর রক্তের বিনিময়ে ঘাতকদের টার্গেট ব্যর্থ হয়ে শেখ হাসিনা বেঁচে যান। একই বছর ১০ আগস্ট রাত ১১টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর ভবনে একদল দুষ্কৃতকারী গুলিবর্ষণ করে। ঘাতকদের টার্গেট শেখ হাসিনা এ সময় বাড়ির ভেতরই অবস্থান করছিলেন, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এর পরও থেমে থাকেনি ষড়যন্ত্রকারীরা। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে পতন হয় স্বৈরশাসক এরশাদের। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবনে শুরু হয় আরেক অধ্যায়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একই বছর ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় উপনির্বাচনে ধানমন্ডি স্কুলে ভোটদানের পর ধানমন্ডির গ্রিন রোডে একটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে ঘাতকরা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সেবারও ঘাতকদের টার্গেট ব্যর্থতায় পরিণত হয়। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে সারা দেশ যখন আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল; সেই মুহূর্তে দেশব্যাপী লংমার্চের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ট্রেনে যাওয়ার পথে পাবনার ঈশ্বরদী ও নাটোর স্টেশনে শেখ হাসিনার ট্রেনের কামরা লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি করে ঘাতকরা। কিন্তু শেখ হাসিনা অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান।

এরপর ১৯৯৫ সালের মার্চে পান্থপথে আওয়ামী লীগের দলীয় সভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়। একই বছর ৭ ডিসেম্বর শেখ রাসেল স্কয়ারে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। ১৯৯১-১৯৯৬ সালের বিএনপি সরকারের আমলে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে শেষ হামলা চালানো হয় ১৯৯৬ সালে। কার্জন হলের একটি অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে। কিন্তু প্রতিবারই ঘাতকরা ব্যর্থ হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনা অক্ষত অবস্থায় বেঁচে গেছেন। ১২ জুন ১৯৯৬ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পন্থায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকচক্র এবং দোসররা, স্বাধীনতাবিরোধীরা তাকে হত্যার নতুন পন্থা খুঁজতে থাকে। ১৯৯৬ সালের ১৫ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে বোমা হামলার পূর্বপরিকল্পনা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আগেই ফাঁস হওয়ায় চক্রান্তকারীরা ব্যর্থ হয়। এরপর ১ মে ১৯৯৭ সালে রমনার বটমূলে শেখ হাসিনার অনুষ্ঠানে প্রবেশকালে ২৩ রাউন্ড গুলি ও রিভলবারসহ আনিছুল বারী নামে এক যুবককে পুলিশ গ্রেফতার করে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনাকে যতবার হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে, তা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এ পরিস্থিতিতে এবং গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালে সংসদে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য বিল পাস হয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরিকল্পিতভাবে সে আইন বাতিল করে শেখ হাসিনাকে নিরাপত্তাহীন অবস্থায় ফেলে ঘাতকদের উসকে দিয়ে হত্যার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে সে ঘৃণিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে নারকীয় হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ঘাতকদের মূল টার্গেট ব্যর্থ হয়। গুরুতর আহত হয়েও বেঁচে যান শেখ হাসিনা। এরপর তারেক-বাবরের পরিকল্পনায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারীদের আড়াল করতে ঘৃণিত ধীকৃত মিথ্যাচার নাটক আমাদের সবারই জানা।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচনে জয়ের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী গোষ্ঠী, ইসলামী জঙ্গি এবং ১৯৭৫ সালের ঘাতক ও দোসরদের রক্তচক্ষুতে পরিণত হয়েছেন। তার সামনে এখন অসংখ্য যুদ্ধের ফ্রন্ট। প্রতি মুহূর্তেই ওঁৎ পেতে বসে আছে ঘাতকচক্র। সুযোগ পেলে তারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করবে। দেশকে ওরা বানাতে চায় জঙ্গিবাদী কিংবা মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য। সেসঙ্গে খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, লুটপাট তথা নৈরাজ্যময় এক বিবর্ণ বাংলাদেশে পরিণত করতে তারা সদা তৎপর। যেমনটি করেছিল ২০০১-০৬ সালে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, ওরা পরাজিত হবে। সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় জননেত্রী শেখ হাসিনা বহুমুখী যুদ্ধের এ ময়দানে অবশ্যই সফল হবেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রত্যেক প্রগতিশীল বাঙালিকে এ যুদ্ধে শরিক হতে হবে। সামাজিক আন্দোলন এবং গণজোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে যুদ্ধের কাতারে শামিল হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শেখ হাসিনা,একুশে আগস্ট,ট্র্যাজেডি,মানবঢাল,আওয়ামী লীগ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close