ড. ফোরকান আলী

  ২১ জুলাই, ২০১৯

ঈদুল আযহার ত্যাগ ও মহিমা ।। পর্ব ২

পূর্ব প্রকাশের পর থেকে

ইসলাম ধর্ম মতে কুরবানি হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সময় থেকে পরিলক্ষিত হয়। পৃথিবীর প্রথম কুরবানি দিয়েছিলেন হাবিল ও কাবিল। যখন হাবিল ও কাবিল দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ চলছিল, তখন আদম (আ.) তাদের প্রত্যেককে কুরবানি করতে বলেন এবং আল্লাহ হাবিলের কুরবানি কবুল করেন। আমাদের নিকট কুরবানি হচ্ছে আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের। কুরবানির শিক্ষা হচ্ছে পাপ ও অনাচার থেকে রক্ষা পাওয়া। শয়তানের ওয়াসওয়াসা কিংবা রিপুর তাড়ণা দূর করাও কুরবানির অন্যতম শিক্ষা। কুরবানির আরেকটি সামাজিক শিক্ষা হচ্ছে পিতার আদেশ সন্তানের জন্য অবশ্যই পালনীয়। এছাড়া মুসলিম নারী, ভগ্নি ও স্ত্রীর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বিবি হাজেরা (আ.)। আমরা যেন ঈদুল আযহার ত্যাগের আদর্শ হতে বিচ্যুত না হই। মুসলমান হিসাবে তাই আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ, আল্লাহর নিকট আমাদের কখনো কুরবানিকৃত পশুর রক্ত, মাংস, হাড় ইত্যাদি পৌঁছায় না। পৌঁছায় শুধু আমাদের আন্তরিকতা ও তাকওয়া বা খোদাভীতি।

আরও পড়ুন : ঈদুল আযহার ত্যাগ ও মহিমা ।। প্রথম পর্ব

হজ্ব : রসুলের (সা.) বাণী: ১. হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এ ঘরে (অর্থাৎ কাবা ঘরে হজ্ব করতে) এলো, স্ত্রী গমন এবং কোনো প্রকার অশ্লীলতা ও ফিস্ক ফুজরীতে নিমজ্জিত হয়নি, তবে সেখান থেকে (এমন পবিত্র হয়ে) ফিরে আসে, যেমন নিষ্পাপ অবস্থায় মায়ের গর্ভ থেকে সে ভ‚মিষ্ঠ হয়েছিল। (মুসলিম)

২. আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুল (সা.) আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, হে লোকেরা, আল্লাহ তোমাদের জন্যে হজ্ব ফরজ করেছেন। অতএব হজ্ব কর। (মুনতাকী)

৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন, তোমরা হজ্ব ও উমরা পর পর আদায় কর, কেননা এ দুটি কাজ দারিদ্র্য ও গুণাহ খাতা নিশ্চিত করে দেয়। যেমন রেত লোহার মরিচা ও স্বর্ণ-রৌপ্যের জঞ্জাল দূর করে দেয়। আর কবুল হওয়া হজ্বের সওয়াব জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়। (তিরমিযী, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)

৪. হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হজ্বের ইচ্ছা পোষণকারী যেন তাড়াতাড়ি তা সমাপন করে। কেননা সে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, তার উট হারিয়ে যেতে পারে বা তার ইচ্ছা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। (ইবনে মাজাহ)

৫. হযরত হাসান (রা.) হতে বর্ণিত, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেছেন, আমার ইচ্ছে হয় এসব শহরে লোক পাঠিয়ে খবর নিই, যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্ব সমাপন করছে না এবং তাদের উপর জিযিয়া ধার্য করি। ওরা মুসলিম নয়, ওরা মুসলিম নয়। (মুনতাকী)

৬. হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন আমল অধিক উত্তম? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান। জিজ্ঞেস করা হল অতঃপর কি? তিনি বললেন আল্লাহর পথে জিহাদ। জিজ্ঞেস করা হল তারপর কোন আমলটি সর্বোত্তম? বললেন, কবুল হওয়া হজ্ব। (বুখারী, মুসলিম)

পবিত্র কাবা শরীফ: মুসলমানদের কেবলা কাবা শরীফ। এ কাবা শরীফ মহান আল্লাহতায়ালার এক অপূর্ব সৃষ্টি। প্রতিবছর লাখ লাখ মুসলমান কাবাঘর তওয়াফ করতে মক্কা গমন করেন। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা কাবাঘর নির্মাণ করে। কাবাঘরকে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরা আল-ইমরানের ৯৬ আয়াতে বলেন, “নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের ইবাদত রূপে নিরূপিত হয়েছে, তা ঐ ঘর যা মক্কাতে অবস্থিত”। কাবাঘরটি আল্লাহর আরশে মুয়াল্লাহর ছায়াতলে সোজাসুজি বাইতুল মামুরের আকৃতি অনুসারে স্থাপন করেন। হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.) এর পৃথিবীতে মিলন হলে তারা উভয় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ইবাদতের জন্য একটি মসজিদ হযরত আদম (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন এবং বাইতুল মামুরের আকৃতিতে পবিত্র কাবাঘর স্থাপন করেন। এখানে হযরত আদম (আ.) সন্তুষ্ট চিত্তে আল্লাহর ইবাদত করতে থাকেন (শোয়াব-উল-ঈমান, হাদিসগ্রন্থ)।

আবার অনেক তফসীরবিদের মতে, মানব সৃষ্টির বহু আগে মহান আল্লাহ তায়ালা কাবাঘর সৃষ্টি করেন। তফসীরবিদ মজাহিদ বলেন, “আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাইতুল্লাহর স্থানকে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে দুহাজার বছর আগে সৃষ্টি করেন”। মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে হযরত আবু যর গিফারী হতে বর্ণনা হয়েছে, রাসুল (সা.) এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ হচ্ছে মসজিদে হারাম। এরপরের মসজিদ হচ্ছে মসজিদে আকসা। মসজিদে হারাম নির্মাণে ৪০ বছর পর মসজিদে আকসা নির্মিত হয়”। হযরত আদম (আ.) কাবাঘর আল্লাহর আদেশে নির্মাণ করেন। এরপর বহুদিন অতিক্রম হয়েছে। শতশত বছর অতিবাহিত হয়েছে। আল্লাহর বান্দারা কাবাঘর জিয়ারত করতো, আল্লাহর কাছে হাজিরা দিতো এ কাবাঘরে সমবেত হয়ে। কাবাঘরে এসে মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও অংশীদারহীনতা ঘোষণা দিত। “লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা, লাকাওয়ালা মুলক, লাশারিকা, লাকা লাব্বাইক”। এভাবে চলতে চলতে দিন গত হতে থাকলো। এরপর হযরত শীষ (আ.) কাবাঘর পুনঃনির্মাণ করলেন। দিন দিন একাত্ববাদের সংখ্যা বাড়তে থাকল। এরপর কাবা শরীফ নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ করেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)। হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত ইসমাইল (আ.) কে সাথে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ বা পুননির্মাণ করেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) কাবাঘর সংস্কার করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। “হে আমার প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে আজ্ঞাবহ কর, আমাদের বংশ থেকে একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজ্বের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। নিশ্চয়ই তুমি দয়ালু। হে প্রতিপালক! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের কাছে একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন। যিনি তাদের কাছে তোমাদের আয়াত তেলাওয়াত করবেন। তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন এবং পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমি মহাপরাক্রমশালী। এরপর কয়েকশ বছর পর পবিত্র কাবাঘর সংস্কার করে আমালিকা সম্প্রদায়। তারপর আরো শ শ বছর কিংবা হাজার বছর পরে কাবাঘর সংস্কার করে মক্কার জুরহাস সম্প্রদায়। আরবের অর্থাৎ মক্কায় যে সকল গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি ছিল, তাদের দায়িত্ব ছিল কাবাশরীফ রক্ষণাবেক্ষণের। এ দায়িত্ব পালনকে তারা সম্মানিত ও গর্বের মনের করতো। শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হয়। এর পর কাবা শরীফ ও কাবা ঘর সংস্কার করেন মোযার সম্প্রদায়।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) নবুয়ত প্রাপ্তির ৫ বছর আগে কাবাঘর সংস্কার করে মক্কার বিখ্যাত কোরাইশ বংশ। এ কোরাইশ বংশেই মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রীঃ জন্মগ্রহণ করেন। কোরাইশরা কাবা শরীফ সংস্কারের পর হাযরে আসওয়াত স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। সকলের সম্মতিক্রমে আল্লাহর রাসূল কাবাগৃহে হাযরে আসওয়াদ কাবা শরীফে স্থাপন করেন। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) জীবিত অবস্থায় ৬৪ হিজরীতে আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রা.) কাবা শরীফ সংস্কার করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৭৪ হিজরীতে কাবা শরীফ সংস্কার করেন। সুদীর্ঘ ১৪শ বছরে কাবাগৃহে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হয়নি। শুধুমাত্র কাবাঘরের চারপাশে অবস্থিত মসজিদে হারামের পরিবর্ধন, সংস্কার বা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সৌদি রাজপরিবারের। সৌদি সরকারের প্রধান (বাদশাহ) কাবা শরীফের মোতোয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে থাকে। ভৌগোলিক দিক দিয়ে মক্কা ও আরব উপদ্বীপ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যস্থলে অবস্থিত। মক্কানগরীর পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় মহান আল্লাহ কাবাঘর মক্কাতেই স্থাপন করেন। পবিত্র হজ্ব পালন করতে হয় মাসের ১০ তারিখ ঈদুল আজহার দিন। এদিন কোরবানী দিতে হয়। যা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর ও হযরত ইসমাইল (আ.) এর স্মৃতি বহন করে চলছে হাজার হাজার বছর ধরে। যমযম ক‚পও ঠিক তেমনি হযরত ইসমাইল (আ.) ও তার মা বিবি হাজেরার (আ.) স্মৃতি বহন করে চলছেন। এ যমযম ক‚প মহান আল্লাহর কুদরতের অপরূপ ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

চলবে-

লেখক: গবেষক ও শিক্ষাবিদ পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঈদুল আযহা,ত্যাগ ও মহিমা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close