ড. ফোরকান আলী

  ২০ জুলাই, ২০১৯

ঈদুল আযহার ত্যাগ ও মহিমা

পবিত্র ঈদুল আযহা অর্থাৎ কুরবানির ঈদ। মুসলমানদের দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব। ঈদ বা আনন্দ উদযাপনের দিন। ত্যাগ ও মহিমার দিন। ত্যাগ এই অর্থে যে, এ দিনে সবচেয়ে প্রিয়বস্তুকে কুরবানি করার ইতিহাস রচিত হয়েছে। মিল্লাতে আবা ইব্রাহিম বা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) প্রথম এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন আল্লাহ্র রাসূল। ঈমানের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি খলিলুল্লাহ বা আল্লাহ্র দোস্ত উপাধি লাভ করেন। তিনি তার মূর্তিশিল্পী ও মূর্তিপূজারী পিতার ন্যায় চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, তারা, নক্ষত্র ইত্যাদি নয়, বরং আসলামতু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ ঘোষণার দীপ্ত আবেগে এক আল্লাহর রাহে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ইব্রাহিমের (আ.) ঈমান পরীক্ষার জন্য মহান আল্লাহ্ একদিন স্বপ্নাদেশে তার প্রিয়পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে কুরবানি করতে বললেন। বহু বহু বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর আল্লাহর মেহেরবানীতে তিনি ৮৬ বছর বয়সে একমাত্র পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন। কিন্তু ঈমানের এ পরীক্ষায়ও তিনি উত্তীর্ণ হন। মিনায় হযরত ইসমাইল (আ.) কে কুরবানি করতে গিয়ে স্নেহাধিক পুত্র কিংবা প্রাণাধিক স্ত্রী মা হাজেরা (রা.) ধৈর্য ধারণ করেন। তারা আল্লাহর নির্দেশ জেনে বরং নিজেকে আত্মোৎসর্গ করতে পেরে খুশি হয়েছিলেন। এটিই কুরবানি ঈদের শিক্ষা। এখানে ত্যাগটাই বড় কথা। অর্থাৎ আল্লাহ্র সন্তুষ্টিকল্পে নিজের জান ও মালকে কুরবানি করতে সদাপ্রস্তুত থাকতে হবে। তাই পশু কুরবানির সময় এ আয়াতটি পাঠ করা হয়, ’ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মরণ সব কিছুই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে নিবেদিত (৬ঃ১৬২)।

আরবী মাসের দ্বাদশ মাস জিলহজ্ব। এ মাসে হজ্বের বিধান পালন করা হয় বলে এ নামকরণ হয়েছে। ইসলামের পঞ্চম রোকন হজ্বের একটি বিধান কুরবানি করা। এটি ওয়াজিব। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও যে কুরবানি করবে না, সে যেন আমার ঈদগাহের ধারে কাছেও না আসে (মুসনাদে আহমদ ও ইবনে মাজাহ)। মূলত: ‘কুরব’ শব্দমূল থেকে কুরবানি শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ নৈকট্য। এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিল করা যায় বলে একে বলা হয় কুরবানি। ১০ জিলহজ্ব এ বিধানটি পালিত হয়। আর সে সঙ্গে মুসলিম জাহানে পালিত হয় কুরবানির ঈদ। তাই হজ্ব, কুরবানি ও ঈদ পরস্পর সম্পর্কিত।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের দেশে কুরবানি নিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এসব ভুল ধারণা দূর করতে মসজিদের ইমামগণ বড় ভ‚মিকা পালন করতে পারে। কুরবানি যে কেউ ইচ্ছা করলে করতে পারে। কিন্তু শুধু মালেকে নিসাবের ওপরই কুরবানি ওয়াজিব। অর্থাৎ যাহার নিকট সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা ততোমূল্যের গচ্ছিত অর্থকড়ি নাই, তার ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যা হচ্ছে অন্যখানে। অনেকে নিজেদের অর্থসম্পদ, বংশ-গরিমা, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি প্রদর্শন করতেই যেন পশু কুরবানি দিয়ে থাকে। আবার এমন অনেক আছে যারা লোকচক্ষুর ভয়ে কিংবা লাজ-লজ্জায় ধার-কর্জ করে হলেও কুরবানি দিয়ে থাকে। কাউকে যেন এরূপ লজ্জায় পড়তে না হয় তা ভাবাও সমাজের কর্তব্য। এছাড়া কুরবানি করতে গিয়ে সাত শরীকের প্রত্যেকেরই নিয়ত সহিহ হওয়া বাঞ্ছনীয়। শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত থাকলে কারো কুরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে কুরবানির মাংস নিয়মানুযায়ী বিলি-বন্টন না করে ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়। এটাও ঠিক নয়। কুরবানির পশুকে নানা রঙে সজ্জিত করাও উচিত নয়। এনিয়ম আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে আরবে প্রচলিত ছিল। কুরবানির প্রচলন শুধু ইসলামে নয়, অন্যান্য ধর্মেও রয়েছে। ইহুদীদের মতে কুরবানি মানে সাধারণ দিনের ন্যায় পশু জবাই করা। তবে তারা মাংস তিন ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং তৃতীয় ভাগ সিনাগগ বা উপসনালয়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। আবার খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের মতে, কুরবানি মানে এক ধরনের পবিত্র নৈশভোজ।

চলবে-

লেখক: গবেষক ও শিক্ষাবিদ পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঈদুল আযহা,ত্যাগ ও মহিমা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close