০৭ জুলাই, ২০১৯

মরার উপর খাড়ার ঘা

হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে কিশোর অপরাধ। রীতিমতো খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, মারামারি ও মাদকের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অল্প বয়সীরা। আজকাল খবরের শিরোনাম হচ্ছে কিশোর গ্যাংদের নিয়ে। কথা হচ্ছে তারা কীভাবে তৈরি হচ্ছে? তাদের উৎস কোথায়? কারা তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে? তথাকথিত সমাজপতিরাই কী পেছনে থেকে কলকাঠি নাড়ছে? নাকি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা বেড়ে উঠছে? যেখানে দেশের কোমলমতি কিশোর-কিশোরীরাই জাতির ভবিষ্যৎ। সেই কিশোর-কিশোরীদের যথোপযুক্ত ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিবার, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র সঠিক কোনও কর্মপন্থা ও নীতি আজও নিরূপণ করে উঠতে পারেনি। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দীনতা এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে। মরার উপর খাড়ার ঘা-এর মত রয়েছে তথাকথিত ডিজিটাল তত্ত্ব এবং অবাধ আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন। ফলে অধিকাংশ কিশোর-কিশোরীর মধ্যে সুকুমার বৃত্তির চর্চা তো দূরের কথা প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষাও অনুপস্থিত। উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে তাদের মধ্যে বখাটেপনা এবং নিত্য নতুন অপরাধ প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ক্রমেই। আরও একটি বিষয় এড়িয়ে গেলে চলবে না। শিশুর প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ তাকে অপরাধী করে তোলে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই শিশু-কিশোররা নানারকম বাজে আচরণ কিংবা দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে থাকে। যেমন স্কুলে কোনও ছেলেকে কেউ মারধর বা র‌্যাগিং করলে শিশুর মননে ক্ষোভের জন্ম নিতে পারে। এক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষেরই উচিত যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া । পরিবারেরও এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। তাহলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।

দেশ এখন নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সমাজের শঙ্কাময় পরিস্থিতিতে কিশোর সমাজ নৈতিকতার পাঠ কোথায় পাবে? কিশোর অপরাধ শুধু শহর-নগরেই নয় এর আঁঁচ সোদাগন্ধের পথ ধরে আঁঁচড়ে পড়েছে মফস্বলেও। নৈতিকতার সব কাঠামো যেখানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, সেখান থেকে ফিরে আসতে অভিভাবকদের বলবো, আসুন অন্তত: আরেকবার মরে বাঁচি।

এটাও কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়- কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ হতাশা। পিতা-মাতার বিবাহ বিচ্ছেদ, অভাব, অতিরিক্ত শাসন, শিশুশ্রম এবং ভালোবাসা বঞ্চিত শিশু-কিশোররাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, বস্তির প্রসার ও অপরিকল্পিত নগরায়ন, যৌথ পরিবার প্রথার বিলুপ্ত, যথাযথ অভিভাবকত্ব না থাকা এবং সামাজিক অস্থিরতা ও অবক্ষয় তাই সমস্ত অপরাধ এবং বখাটেপনার সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্র এবং সমাজকে এসব নির্মূলের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এই কথাটা জোড় দিয়ে বলতে চাই, আধুনিকতার নামে বেশির ভাগ মা-বাবা তাদের সন্তানদেরকে নৈতিক শিক্ষা হতে দূরে রাখার কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। সে সাথে বাড়ছে বখাটেপনা। সুতরাং আধুনিকতার নামে অতি আধুনিক হতে চাওয়াটা বিপর্যয় ডেকে আনে। আমরা পুলিশকন্যা ঐশির কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। যে কিনা বাবা-মা দুজনকেই খুন করেছে। এরকম আরও বহু ঘটনা যা প্রতিনিয়ত ঘটছে। কিছু ঘটনা মিডিয়ার কল্যাণে সামনে আসছে আর কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা কালের আবর্তে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। যার কোনও প্রতিকার হওয়া তো দূরের কথা সুবিচারও পাবেনা ভুক্তভুগিরা।

সদ্য ঘটে যাওয়া বরগুনার ঘটনা এখনো সবার মনে দাগ লেগে আছে। নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজি এদের বয়স কতো? এরা কি গতকাল বা পরশু তৈরি হয়েছে? না। এদের উত্থান কিশোর বয়সে। বহু আগে থেকেই ০০৭ নামের গ্রুপটা সমাজে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলো। যার পরিণতি এখন সবার জানা।

অনেককে বলতে শোনা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশে অপরাধ কম বেশি বেড়েছে। কিশোর অপরাধের পরিণতি হল বড় ধরণের অপরাধ। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হল নৈতিকতার শিক্ষা। মাদকের ভয়াবহতাও এক্ষেত্রে দায়ী। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ইন্টারনেটের বিস্তৃতি যেমন নৈতিক অবক্ষয় ঘটাচ্ছে তেমনি হাতের নাগালে মাদকও মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখিন। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মাদক সেবনকারীদের মধ্যে কিশোরদের সংখ্যা কোনও অংশে কম নয়। সীমান্তে অবাধে মাদক প্রবেশ করতে না দেয়া ও সামাজিকভাবে কিশোর অপরাধের শাস্তি বিধান করতে পারলে কিশোর অপরাধের প্রবণতা কমে আসবে বলেও অনেকের কাছ থেকে ধারণা পাওয়া গেছে।

এক সময় ছিল যখন প্রতিটি মুহূর্ত মা-বাবা বা অভিভাবকদের নিবিড় পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণে থাকত শিশু-কিশোররা। কিন্তু আজকাল তা পরিলক্ষিত হয় না। দেখা যায়, মা-বাবা দুজনই ব্যস্ততার কারণে নিজেদের আদরের সন্তানদের মোটেই সময় দিতে পারেন না। তাই অনেক সময় নিরাশ হয়ে তারা তাদের খারাপ বন্ধুদের সংসপর্শে এসে অপরাধীর খাতায় নাম লেখায় এবং সেইসঙ্গে তাদের বখাটেপনাও বৃদ্ধি পায়।

দৈহিক ও জৈবিক তাড়নার স্বাভাবিক তত্পরতায় একজন মানুষ ও ইতর প্রাণীর মধ্যে তেমন প্রভেদ নেই। কিন্তু নৈতিক গুণাবলী, মানবীয় তত্পরতার মধ্যেই মনুষ্যত্বের বিকাশ। আবার এক পলকে একটু দেখা অতঃপর অনেকখানি মেলামেশায় অনেকটুকু অশ্লীলতার জন্ম নিতে পারে। তাই এজন্য নারী ও পুরুষের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা থাকা জরুরি। তাই কিশোর অপরাধ ও বখাটেপনা প্রতিরোধে সবার মধ্যে ধর্মীয়-মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে এবং অভিভাবকদের হতে হবে সচেতন।

রিহাব মাহমুদ, সাংবাদিক ও লেখক

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ভয়ংকর অপরাধ,দায়ী,কিশোর অপরাধ,রিহাব মাহমুদ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close