সাজ্জাদ হায়দার

  ২৭ এপ্রিল, ২০১৯

সাংবাদিকের নামে এই দুর্নাম!

সাংবাদিকদের তাহলে পকেটমারের তালিকায় রাখা যায়! পকেটমারদের খুঁজে না পেলে এখন থেকে পুলিশ কয়েকজন সাংবাদিককে খুঁজে নেবে! পকেটমার ধরা সহজ হয়ে গেল!

আজ মানিক ভাইকে খুব মনে পড়ছে—নাজিমউদ্দিন মানিক, আমার গুরু। তাকে চিনতাম কিশোরবেলায়। তিনি সাপ্তাহিক কিশোরবাংলায় কাজ করতেন, গুরু-গম্ভীর, একে-তাকে ধমকাতেন। কাউকে পরওয়া করতেন না। এক দিন ভয়ে ভয়ে একটা লেখা নিয়ে হাজির হই তার সামনে। লেখাটা দেব, কী দেব না, ভাবছি। তিনি হাত বাড়িয়ে লেখাটা প্রায় ছিনিয়ে নিলেন। ভাঁজ খুলে এক-দু লাইন পড়লেন; তারপর টেবিলে রাখা বেলে চাপ দিলেন। এবার বোধহয় আমার মুখের ওপর লেখাটা ছুড়ে মারবেন আর আমাকে গলা ধাক্কা দেওয়ার জন্য পিয়নকে ডাকছেন। পিয়ন এসে সালাম দিয়ে দাঁড়াল। তিনি আমার লেখাটা পিয়নের হাতে দিয়ে বললেন, কম্পোজে দিয়ে দে। পিয়ন হাত বাড়িয়ে আমার লেখা নিয়ে চলে যায়। মানিক ভাই আমার দিকে না তাকিয়ে টেবিলের ওপর রাখা অন্য একটি লেখায় চোখ বুলাতে লাগলেন। আমি বিপদে পড়ি এ লেখার কোনো কপি নেই; যদি ছাপা না হয়, তবে লেখা আর পাওয়া যাবে না। নিজের লেখা বলে কথা! ব্যাপারটা তাকে বলতে সাহস হচ্ছে না। ভাবছি কী করব। তিনি মুখ তুলে তাকালেন, কি রে এখনো বসে আছিস যে! ভাগ এখান থেকে! এই লোকের সামনে আর থাকা যায় না। নিজেকে ধিক্কার দিলাম, অপাত্রে লেখা দিয়েছি বলে।

কয়েক দিন পর কিশোরবাংলার সদ্য প্রকাশিত সংখ্যায় দেখলাম আমার লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। ছোটদের লেখা পাতায় নয়। বড়দের লেখা ছোটদের জন্য গল্পের পাতায়। কয়েক বছর পর, বাংলার বাণী পত্রিকা অফিসে গিয়ে বললাম, সাংবাদিক হতে চাই। ততক্ষণাৎ তিনি বার্তা বিভাগের সেন্টার টেবিলে বসিয়ে দিলেন। আমার চাকরি হয়ে গেল। মানিক ভাই সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন। বাকশালের গুণগান করেন। একদিন বললাম, এত বাকশাল বাকশাল করেন আপনি বাকশালে যোগ দেননি কেন? তিনি থমক দিলেন, তুই দেখছি আহাম্মক, আরে বোকা বাকশাল একটা রাজনৈতিক দল। আমি যখন ওই দলে যাব তখনই আমি ওই দলের কর্মী, তখন আমি আর সাংবাদিক না। সাংবাদিক কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে নিরপেক্ষতা আর স্বাধীনতা দুই-ই হারায়। এই দুটি হারালে সাংবাদিকতার আর থাকলটা কী? বুঝলাম বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ হয়েও কেন তিনি বাকশালে যাননি, বেকার থেকেছেন, সরকারি চাকরি নেননি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর অন্যরা নীরব অথবা মৃদু গলায় প্রতিবাদ জানালেও মানিক ভাই উচ্চৈকণ্ঠে প্রতিবাদমুখর হয়ে প্রেস ক্লাবের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ছিলেন। এসব কথা বলে তিনি নিজেকে জাহির করেননি। অন্যের মুখে শোনা।

দৈনিক বাংলার বাণীতে নিয়মিত বেতন নেই, সেজন্য তার কোনো ভাবনা নেই। আগামীকালের পত্রিকায় কী ধরনের হেডিং করলে এরশাদের ১২টা বাজবে, সেই ভাবনায় মশগুল থাকতেন। চাইতেন আমরা তার মতো ভাবি। টাকার কথা বললে বলতেন, টাকা কামাতে হলে ব্যবসা কর, করপোরেট অফিসে চাকরি নে। সাংবাদিকতা হলো জনগণের সেবা, একটা সার্ভিস, একটা মিশন। সেসময় তিনি চাইলেই এরশাদের কাছ থেকে গাড়ি-বাড়ি, উচ্চপদ সবই জোগাতে পারতেন।

যিনি সাংবাদিকতাকে এতটা ভালোবাসতেন, তিনি কী পেলেন? তার চেয়ে অযোগ্যরা ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ হয়ে অনেক ওপরে ওঠে গেলেন। তিনি হয়ে গেলেন অপাংতেয়। বেকারত্ব তার নামকে সাংবাদিক তালিকা থেকে খাজির করে দিয়েছিল। মৃত্যু দিনেও এখন কেউ তাকে স্মরণ করে না। সত্যি তিনি শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডির হতভাগ্য নায়ক; যিনি সাংবাদিকতার জন্য লড়াই করেছেন, সাংবাদিকতার মর্যাদা রক্ষায় আপসহীন ছিলেন, সেই সাংবাদিক জগতের কাছেই তিনি পরাজিত হয়েছেন, কলুষিত হতে দেখেছেন সাংবাদিকের মর্যাদা।

সেদিন নাকি প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে মোবাইল ফোন খোয়া যাওয়ার পর অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকদের দেহ তল্লাশি করা হয়। পরে আমাদের সাংবাদিকরা এ স্বস্তি লাভ করেন যে, মোবাইল দুটি পাওয়া গেছে। পাওয়া না গেলে হয়তো তারা পুলিশের জেরা, মামলা এমনকি জেলের ভাত খেতেন।

সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অর্ধশত সাংবাদিক—এলাহি কারবার। দেশ ও জাতির জন্য বোধহয় বিশাল কিছু হতে চলছিল সেখানে, নয়তো ৫০ জন সাংবাদিক কেন যাবেন?

যখন সক্রিয় সাংবাদিকতায় ছিলাম তখন দেখতাম, নিউজ এডিটর অথবা চিফ রিপোর্টার গুরুত্ব বুঝে সংবাদ কাভার করার জন্য রিপোর্টার পাঠাতেন; সেসব নিউজ প্রথম পাতা অথবা শেষের পাতায় ছাপা হতো। কোনো একটা দোকান খুলে কেউ প্রেস কনফারেন্স ডাকলেই রিপোর্টাররা পঙ্গপালের মতো ছুটতেন না। আর ধান্দাবাজরাও থলের বিড়াল বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে রিপোর্টারদের কাছ থেকে দূরে থাকত। এখন উল্টো পুরাণ—ধান্ধাবাজিকে জায়েজ করতে রিপোর্টারদের লাগে। নয়তো সেদিনের এ রকম একটি প্রতিষ্ঠানের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে এত সাংবাদিক আধিক্য কেন? পত্রিকার প্রথম অথবা শেষ পাতার স্থান পাওয়ার মতো কী খবর সেখানে উৎপন্ন হতো?

ধরা যাক, সরকারের একজন শীর্ষ নির্বাহী সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। সেখানে এমন কয়েকজন সাংবাদিক আছেন যারা চলতি পথে স্বার্থসিদ্ধির হীরকখন্ড পড়ে থাকতে দেখলে ফিরেও তাকান না। ধরা যাক, সেখানে আছেন নাজিমউদ্দিন মানিক, সন্তোষ গুপ্ত, মোস্তান ভাই প্রমুখ। এখন সেখানে সংবাদ সম্মেলন আহ্বানকারীর মোবাইল হারাল। সেই শীর্ষ নির্বাহী কি এদের দেহ তল্লাশি করার নির্দেশ দেবেন? উত্তরটা কী?

আশা করি, এইবার আমাদের নিউজ এডিটর ও চিফ রিপোর্টাররা কর্মরত রিপোর্টারদের অ্যাসাইনমেন্ট প্রদানে একটু সচেতন হবেন। যদুমধু আর... তারকাদের ডাকে সাড়া দিয়ে নির্বিচারে প্রেস কনফারেন্সে গেলে আর যাই হোক সাংবাদিক মর্যাদা থাকবে না, রিপোর্টাররাও বদনামের ভাগি হতেই থাকবেন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সাংবাদিক,দুর্নাম,পকেটমার,সংবাদ সম্মেলন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close