এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৯

ধর্ষণ এক বিকৃত রুচির পরিচায়ক

ধর্ষণ সাম্প্রতিক সময়ের একটি অন্যতম উদ্বেগজনক ও আলোচিত বিষয়। গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ডেকে নিয়ে ওই মাদরাসা অধ্যক্ষের ইন্ধনে কয়েকজন চিহ্নিত দুর্বৃত্ত তার গায়ে আগুন দেয়। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই দিন রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। গত ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে নুসরাত মারা যান। এর আগে গত ২৭ মার্চ মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেন নুসরাতের মা। এ মামলা তুলে নিতে চাপ দিতে থাকে দুর্বৃত্তরা। এতে নুসরাত ও তার পরিবার রাজি হননি। এর জেরেই এত বড় নৃশংস ঘটনা ঘটানো হয়। এ বিষয়ে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন চিকিৎকের কাছে জবানবন্দি দেন নুসরাত।

এই হত্যাকান্ডকে জায়েজ করার জন্য স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও পুলিশের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত, নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের তৎপরতায় অপরাধীরা গ্রেফতার হচ্ছে। এর আগে ২০১১ সালে ঢাকায় ভিকারুন্নেসা স্কুলের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক পরিমল জয়ধরের ধর্ষণের ঘটনা ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃক যৌন নির্যাতনের বড় ঘটনা। যথাযথ বিচারের মাধ্যমে পরিমল জয়ধরের সাজা হয়েছে, যা এখন সে ভোগ করছে। আমরা চাই ফেনীর ঘটনারও দ্রুত ও যথাযথ বিচার হোক।

গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পর নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণ ছিল ব্যাপক আলোচিত। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচিত ধর্ষণগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর তরুণী রূপাকে হত্যা, বরগুনার বেতাগী উপজেলার উত্তর করুণা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে শিক্ষিকাকে গণধর্ষণ, বগুড়ার তুফান কান্ড, বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ ও হত্যা উল্লেখযোগ্য।

অবাক হলেও সত্যি, পবিত্র ঈদুল আজহার দিনেও ধর্ষকরা নিজেদের নিবৃত্ত রাখেনি। হাসপাতালে মাকে রেখে বাড়ি ফেরার পথে এক তরুণী গণধর্ষণের শিকার হয় পটুয়াখালীর বাউফলে। আবার এমন অনেক ধর্ষণের ঘটনা আছে, যেগুলো কখনোই প্রকাশিত হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, অপ্রকাশিত ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত ঘটনার বহু গুণ বেশি। সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এমন ঘটনা এখন আর আমাদের অজানা নয় যে, একবার ধর্ষণ করে তার ভিডিও রেকর্ড করে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে বারবার ধর্ষণ করা, এমনকি দলবদ্ধ হয়ে পৈশাচিক উৎসবে মত্ত হওয়া।

ধর্ষণ হলো যৌনতার এক ধরনের বিকৃত উপস্থাপন। এটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সমাজে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নারী এবং শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। আবার ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটছে। এর মধ্যে কিছু খবরে আসে, অনেকগুলো আবার খবরে আসে না। কারণ ধর্ষণের বেশির ভাগ ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। দুই-একটি ঘটনা মিডিয়াতে এলে আমরা দুই-চার কথা বলি। তারপর সবাই যার যার কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে যাই। এভাবে চলতে থাকলে সামাজিক কাঠামো ও মূল্যবোধ ধ্বংস হওয়া নিশ্চিত। ধর্ষণের ব্যাপারে সচেতন হওয়া ও এর প্রতিকার করা খুবই জরুরি।


ধর্ষণ হলো যৌনতার এক ধরনের বিকৃত উপস্থাপন। এটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সমাজে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নারী এবং শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। আবার ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটছে। এর মধ্যে কিছু খবরে আসে, অনেকগুলো আবার খবরে আসে না


সম্প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, চলতি বছর শুধু জানুয়ারি মাসে দেশে ৫২টি ধর্ষণ, ২২টি গণধর্ষণ এবং পাঁচটি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি আরো জানায়, ২০১৮ সালে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা হয়েছে সারা দেশে। লিখিত বক্তব্যে মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ১৮২ জন নারী গণধর্ষণ, ৬৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ৬৯৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে সংগঠনটি জানিয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব, সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতার কারণে এসব ঘটনায় অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। এছাড়া সস্প্রতি ধর্ষণে অভিযুক্ত কয়েকজন ব্যক্তির গলায় চিরকুট ঝোলানো অবস্থায় লাশ পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সংগঠনটির নেতারা বলেন বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অপরাধী যেই হোক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ধর্ষণের মূল কারণগুলো হলো নগ্নতা, অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্ক্ষা, বেহায়াপনা, অবাধ যৌনাচার, রাস্তার পাশে দেয়ালে নগ্ন পোস্টার, ফুটপাতে অশ্লীল ছবিসংবলিত উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল পত্র-পত্রিকা, অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, ব্লু-ফিল্ম, চলচ্চিত্রে খলনায়ক কর্তৃক নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণের দৃশ্যের মাধ্যমে সমাজে রাস্তাঘাটে বাস্তবে ধর্ষণ করার উৎসাহ জোগান, ইন্টারনেটে অশ্লীল সাইটগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, টোয়েনটি প্লাস চ্যানেলে নীল ছবি প্রদর্শন ইত্যাদি কারণে আজ যুবসমাজের মধ্যে দিন দিন ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণের আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের উদাসীনতা।

একাকিত্ব বোধ, অক্ষমতাবোধ, রাগ, অপমানজনক অনুভূতি, হতাশা, ব্যর্থতা বা ব্যক্তিজীবনে কষ্ট, অপ্রাপ্তি এসব থাকলে ধর্ষণের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পায়। কোনো মেয়ে প্রেমে বা বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে রাজি না হলে মেয়েটির ‘না’ কে সহ্য করতে না পেরে ধর্ষণ করে। সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী লোকেরা ধর্ষণ করে। ধারাবাহিক ধর্ষণের কারণও এটি। মাদকাসক্তি মানুষের স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ লোপ করে, এটিও ধর্ষণের আরেকটি কারণ। ক্ষমতাশীল ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোনো দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় ধর্ষণের মাধ্যমে।

ধর্ষণের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো আইনের প্রতি মানুষের ভয় কম বা নেই। ২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার ধর্ষণ করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ধর্ষণের জন্য মেয়েদের ছোট পোশাককেও দায়ী মনে করেন কেউ কেউ। আমার মতে, নারীদের পোশাক মূল সমস্যা নয়। পুরুষের বিকৃত মানসিকতাই মূলত দায়ী। যদি নারীদের পোশাকই মূল সমস্যা হতো, তাইলে ছোট ছোট শিশুরা কেন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে? ছোট ছোট শিশুদেরতো পোশাকের কোনো সমস্যা নেই। ধর্ষক এখন আর শুধু দূরের কেউ না। কাছেরও অনেকে এ অপকর্মে যুক্ত। ফলে সহপাঠী, বন্ধু, সহকর্মী, ড্রাইভার ও সহকারী, বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক, দুলাভাই, ধর্মগুরু—এমনকি আরো অনেকে এ তালিকাকে ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করছে। এর মধ্যে আরো এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আরো অমানবিক। যেমন ধর্ষণের পর নির্মম হত্যা, বাবা-মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ, মা-মেয়েকে একসঙ্গে ধর্ষণ অথবা স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ ইত্যাদি। এদের নিবৃত্ত করতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত-২০০৩)’, যেখানে ধর্ষণের দায়ে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড (বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড) ও অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। নারীর অধিকার রক্ষায় সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদে বিশেষ ক্ষেত্রে নারীর অগ্রাধিকার প্রদানসহ রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভের বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। সংবিধান ও জাতিসংঘের সিডও সনদের আলোকে তৈরি করা হয়েছে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১’। এতকিছুর পরও বন্ধ হচ্ছে না ধর্ষণ নামক এই ব্যাধি।

ধর্ষণের প্রতিকারের বিষয়ে প্রথমে আমাদের পারিবারিক শিক্ষাকে বিবেচনায় নিতে হবে। পরিবার থেকে আমরা সঠিক শিষ্টাচার ও মূল্যবোধের শিক্ষা পাই। পরিবারের মুরুব্বি ও কর্তাব্যক্তিদের সচেতন হতে হবে, ছোট সদস্যদের সচেতন করতে হবে। ছেলেমেয়েদের যথাসময়ে বিয়ের ব্যবস্থার বিষয়ে পরিবার থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবারের কেনো সদস্য এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে অপরাধ গোপন না করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই ধর্ষণরোধে চাই সরকারের কার্যকর ও কঠোর পদক্ষেপ। ধর্ষণকারীর বিচার হতে হবে অতিদ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক। ধর্ষণসহ যে কোনো অপরাধ করে যেন কেউ পার পেয়ে না যেতে পারে সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। যাতে করে অন্য কোনো পুরুষ এই পাপ কাজটি করার আগে শতবার চিন্তা করে। অশ্লীল পত্র-পত্রিকা ও বইয়ের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। ধর্ষণ শুধু একটি ব্যাধি নয়, এটি দেশ ও জাতির জন্য অনেক বড় একটি অভিশাপ। এই অভিশাপের কালো অধ্যায় থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে। আর সেই গুরুদায়িত্বটি আমার, আপনার ও সবার। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ধর্ষণ নামক ব্যাধি ও অভিশাপ থেকে আমাদের সমাজ রক্ষা পেতে পারে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ধর্ষণ,বিকৃত রুচি,মতামত
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close