আলমগীর খান

  ৩১ মার্চ, ২০১৯

আরডার্নকে বিশ্ব স্বীকৃতি

বিশ্বরাজনীতির অনন্য শিক্ষক

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সাধারণত খবরে আসেন না। কিন্তু ২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই জেসিন্ডা আরডার্ন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি দেশটির নারী প্রধানমন্ত্রী ও কমবয়সি নেত্রী, অবশ্য কোনোটিতেই প্রথম নন। গত বছর জুনে যখন তিনি মা হলেন আবারবিশ্বে সবার নজর কাড়লেন। সম্প্রতি ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে ধার্মিক মুসলিমদের ওপর হামলার পর তিনি যে ধৈর্যশীল মানবতাবাদী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, তা তাকে আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন আজ বিশ্বে যে উদাহরণ তৈরি করলেন তা অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয়। আল নূর মসজিদে বর্বরোচিত হামলা ও ৫০ জন নিরীহ মুসলিম নাগরিককে খুন করার ঘটনায় অনেকেই কেঁদেছেন। হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতার অন্ধত্ব ও ব্যাপকতা কাঁদিয়েছে মানুষকে। কিন্তু আবার কাঁদল অনেক মানুষ। এ কান্না অন্যরকম। প্রথমবার পাথরের আঘাতে রক্তপাত হলো হৃদয়ে, দ্বিতীয়বার ফুলের ঘায়ে গলে গেল হৃদয়। যখন প্রধানমন্ত্রী আরডার্ন তার ভালোবাসা ও সহানুভূতির হাত প্রসারিত করলেন ও আক্রান্ত মানুষকে মায়ের মতো বুকে জড়িয়ে নিলেন।

মানুষ বহুদিন পর আবার দেখল প্রকৃত ধর্ম আসলে কী, সত্যিকার ধর্মের মানে কী। সৃষ্টিকর্তার বরাত দিয়ে ধর্মতো মানুষকে ভালোবাসার কথা বলে—বিশেষ করে আক্রান্ত, নির্যাতিত ও অবহেলিত যে মানবতা তাকে। অথচ আজ অনেকেই ভালোবাসা নির্বাসিত করে ধর্মকে বানিয়ে ফেলেছে ঘৃণার বাহকে। সব ধর্মই শুরুতে ছিল নির্যাতিতের বন্ধু ও প্রেমের প্রচারক। দিনে দিনে ধর্মের অনুসারীরা হৃদয়কে ছুড়ে ফেলে কতগুলো আচার-অনুষ্ঠান ও নিয়মকানুনকে মুখ্য করে তোলে। তখন কোনো ধর্মের অনুসারীর মনে হয় অন্য ধর্মের ও আদর্শের মানুষকে ঘৃণা করাই যেন তার মূল কর্তব্য। যে বা যারা দেখতে ও আচারে তাদের মতো নয়, তাদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ নিয়ে অনেক ধর্মালম্বী বড় হতে থাকে। ঘৃণা ও বিদ্বেষ থেকে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয় সংঘর্ষ, আক্রমণ ও রক্তপাত। ঘৃণা আর কী জন্ম দিতে পারে—ধ্বংস, অনৈক্য ও মানুষে মানুষে অবিশ্বাস ছাড়া! যা এমনকি কোনো জাতির জীবনেও বয়ে আনতে পারে ট্র্যাজেডি।

আমরা আজকের দুনিয়ায় দেখছি, রাশিরাশি ঘৃণার পাহাড়! এখন ঘৃণার উৎপাদন চলছে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। ঘৃণার প্রধান ফেরিওয়ালারা হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদি, সু চির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার ও বিশ্বের নানাস্থানে ছড়ানো এদেরই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলাকারী সন্ত্রাসী এই অন্ধ ঘৃণার অপশক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু সে খুনি যা চেয়েছিল, ফল হয়েছে তার উল্টো। নিউজিল্যান্ডের অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মুসলমানদের যে ফারাক সে তৈরি করতে চেয়েছিল তা বরং মুছে গেছে। আরডার্নের নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডের সব মানুষ আরো কাছে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে বরং এক দেহে এক প্রাণে পরিণত হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ও ওর সন্ত্রাস থেকে যা কিছু চেয়েছিল, তার মধ্যে ছিল কুখ্যাতি—নাম প্রচার। আর তাই আপনারা আমার মুখে ওর নাম শুনবেন না।’ তিনি বলেন, ‘সে সন্ত্রাসী। সে অপরাধী। সে চরমপন্থি। কিন্তু আমার ভাষণে সে থাকবে নামহীন।’

আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা পর আরডার্ন তার ভাষণে সন্ত্রাসীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘তুমি আমাদের বেছে নিয়েছ, কিন্তু আমরা তোমাকে ঘৃণাভরে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করছি।’ রাখঢাক না করে তিনি স্পষ্টতই এ ধরনের বর্বরতার জন্য বিশ্বব্যাপী উসকে দেওয়া বর্ণবাদী জাতিবিদ্বেষ ও ইসলাম-বিদ্বেষকে দায়ী করেছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ফোন করে আরডার্নকে তার কপট সহানুভূতি জানালেন এবং যুক্তরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডকে কী সাহায্য করতে পারে জানতে চাইলেন, আরডার্ন খুব নম্রভাবে তাকে মনুষ্যত্বের শিক্ষা দিলেন। শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের সমর্থক চির মুসলিমবিদ্বেষী ট্রাম্পকে তিনি বললেন, ‘মুসলমানদেরকে ভালোবাসুন।’ বুঝিয়ে দিলেন যে, মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ করলেই ট্রাম্প নিউজিলান্ডের সবচেয়ে বড় উপকার করবেন।

আর কোনো ঘৃণার ব্যাপারীও যদি আরডার্নকে সহযোগিতার প্রস্তাব দিতেন, তারাও একই উত্তর পেতেন সন্দেহ নেই। এই আক্রমণের পরপর তিনি যে ভূমিকা রাখলেন, অকৃত্রিম ভালোবাসার যে হাত প্রসারিত করলেন, যেভাবে মুসলমানদের আপন করে নিলেন, তা বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করল। এ প্রভাব যত সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘস্থায়ী হবে আজকের ঘৃণাজর্জরিত বিশ্বরাজনীতির জন্য ততই মঙ্গল।

প্রধানমন্ত্রী ও তার সমমনা দেশবাসীর অনেকেই গত ২২ মার্চ শুক্রবার শোকদিবসে হিজাব পরেছেন এবং দুই-মিনিট নীরবতা পালন করেছেন। এইদন রেডিও-টেলিভিশনে আজান সম্প্রচারিত হয়েছে। যেখানে আরডার্নের ভাষণে নামহীন সন্ত্রাসীটি মুসলমানদের নিউজিল্যান্ড থেকে আলাদা করতে চেয়েছিল, সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বী ও আদর্শের মানুষ আরো মুসলমানদের কাছে চলে আসে। সন্ত্রাসের প্রতিবাদে তারা হয়ে গেল আক্রান্তদেরই একজন। সন্ত্রাস ও ঘৃণার বিরুদ্ধে এর চেয়ে সফল প্রতিবাদ আর কী হতে পারে?

হামলার ঠিক এক সপ্তাহ পর শুক্রবার সব ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার মানুষের জমায়েতে ইমাম জামিল ফাওদা তার বক্তৃতায় বলেন, ‘আমরা ভগ্ন-হৃদয়, কিন্তু ভেঙে পড়িনি।’ তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবার আমি এই মসজিদে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসীর চোখে দেখেছিলাম ঘৃণা ও ক্রোধ।... আর আজ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি চারদিকে হাজার হাজার নিউজিল্যান্ডবাসীর ও সারা বিশ্বের মানুষের চোখে দেখছি ভালোবাসা ও সহানুভূতি।’ তিনি জনতার উদ্দেশে বলেন, ঘৃণা ধ্বংস হবে ও ভালোবাসা জয়লাভ করবে। ইমাম জামিল ফাওদা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বকে ‘বিশ্বের জন্য একটি শিক্ষা’ বলে আখ্যা দেন। কেননা জাসিন্ডা আরডার্নের নেতৃত্বে দেশটিতে ঘৃণা পরাজিত ও ভালোবাসা প্রস্ফুটিত হয়েছে।

প্রকৃত নেতৃত্ব এই যা মানুষে মানুষে অনৈক্য ও ঘৃণা দূর করে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। আরডার্ন তাই ওই জমায়েতে বলেন, ‘নিউজিল্যান্ড শোকার্ত। আমরা এক।’ বিশ্ব কান পেতে শুনেছে, জাসিন্ডা আরডার্নের বাণী ও নানা প্রান্তের মানুষ তাকে দিয়েছে সালাম। মানুষ যার যার নিজ দেশের জন্য আকাঙ্ক্ষা করেছে আরডার্নের মতো নেতাকে।

২১ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় ছিল : ‘আমেরিকার প্রয়োজন আরডার্নের মতো একজন ভালো নেতা।’ এতে লেখা হয়েছে, ‘এ রকম নৃশংসতার পর জাতিবিদ্বেষকে পরিষ্কার ভাষায় নিন্দা করতে, আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে দুঃখ ভাগ করতে ও ঘৃণার ফেরিওয়ালাদের নিরস্ত্র করতে এখন বিশ্বনেতাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আরডার্ন পথ দেখিয়েছেন।’

এরই মধ্যে দেশটির অস্ত্র আইনে তিনি আমুল পরির্বতন এনেছেন, যে সমস্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বহুকাল ধরে হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনে ও উষ্ণায়নে নিউজিল্যান্ডের ভূমিকা সামান্যই, কিন্তু তিনি এ পরিবর্তন রোধ করতে বদ্ধপরিকর। কেননা ঘরে আছে তার ৯ মাস বয়সি এক শিশু, আছে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা। মাতৃত্ব ও নেতৃত্ব একহয়ে মিশেছে তার মাঝে। নিউইয়র্কার পত্রিকার অ্যামেলিয়া লেস্টারকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি একসময় বলেছিলেন, ‘আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষী এ বিশ্বকে পরিবর্তনের জন্য, তবে কোনো উপাধির জন্য নয়।’ (ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পর জাসিন্ডা আরডার্নের অসামান্য নেতৃত্বের শেকড় সন্ধান, নিউইয়র্কার, ২৩ মার্চ ২০১৯)

জাসিন্ডা আরডার্নের শেখালেন—প্রকৃত নেতা আক্রান্ত মানুষকে আলিঙ্গন করে, পরিত্যক্তকে বুকে টেনে নেয়, দুস্থজনের সঙ্গে নিজের সব ক্ষুদ্র পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলে তাদেরই একজন হয়ে যায়। তিনি আজ বিশ্বনেতাদের শিক্ষক। কিন্তু নেতারা শিখলেন কি? আর তাদের মাঝে কে কতটাইবা মনে রাখবেন বা রাখতে চাইবেন?

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিশ্বরাজনীতি,শিক্ষক,কলাম,জেসিন্ডা আরডার্ন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close