রেজাউল করিম খান

  ১০ মার্চ, ২০১৯

ডাকসু নির্বাচন হোক নান্দনিক

আগামীকাল সোমবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রে পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভোটপ্রদান করবে।

২৮ বছর পর হতে যাওয়া ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এরই মধ্যে সব ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ডেকে আলোচনা, রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, ভোটার তালিকা প্রকাশ, গঠনতন্ত্র সংশোধন, আচরণবিধি প্রণয়নে কমিটি ও পরিবেশ পরিষদের সভা করেছে।

ডাকসু ভবন ও হল সংসদের কার্যালয়গুলো সংস্কার করা হয়েছে। তবে গঠনতন্ত্রকে অনুসরণ করতে গিয়ে প্রশাসনকে একাধিক ছাত্র সংগঠনের বিরোধিতা উপেক্ষা করতে হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে ভোটকেন্দ্র রেখেই ঘোষণা করা হয়েছে ডাকসু নির্বাচনের তফসিল। হলগুলোতে ভোটকেন্দ্র স্থাপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ছাত্রলীগ। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এ তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ঘোষিত তফসিল নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এতদসত্ত্বেও নির্ধারিত দিনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ডাকসু ও হলসংসদের গঠনতন্ত্রের ৬(খ) ও ৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫টি পদে নির্বাচন হবে।

এর মধ্যে সহসভাপতিসহ ১১টি সম্পাদকীয় পদ এবং ১৩টি সদস্যপদে সরাসরি ভোট দেবেন শিক্ষার্থীরা। যেসব পদে শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন সেগুলো হচ্ছে— সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১৩ জন সদস্য। পদাধিকার বলে ডাকসুর সভাপতির দায়িত্বে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। কেন্দ্রীয় সংসদের পাশাপাশি হলসংসদের ১৩টি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ চারজন সদস্য। নির্বাচনে এবার ভোটার প্রায় ৪০ হাজার। ওদিকে সাধারণ ভোটাররা আশঙ্কা করছেন নির্বাচনে কারচুপি হবে। সংঘাতও হতে পারে। তারা চান শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।

তফসিল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন ঘোষিত তফসিলকে স্বাগত জানান। এরপরই ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে ছাত্রলীগ। তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক বাশার সিদ্দিকী বলেছেন, সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনকে ‘জেতানোর আয়োজন’ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতা ও ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি উপস্থাপন করেছিলাম। সে দাবিগুলো অগ্রাহ্য করা হয়েছে। কোটা আন্দোলনকারী পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, বেশির ভাগ ছাত্র সংগঠনই হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র চায়।

ডাকসু নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ২৫ পদের বিপরীতে ২২৯ জন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছেন। এর মধ্যে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ২১ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৪, সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ১৩, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক পদে ১১, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ৯, কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৯, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে ১১, সাহিত্য সম্পাদক পদে ৮, সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১২, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১১, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ১০, সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৪ এবং ১৩ জন সদস্য পদের বিপরীতে ৮৬ জন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছেন।

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে পাঁচটি ছাত্রী হলে একমাত্র ছাত্রলীগ ছাড়া আর কেউ পূর্ণ প্যানেল দিতে পারেননি। ছাত্রদল কেবল শামসুননাহার হলে ভিপি পদে প্রার্থী দিতে পেরেছে। তাদের দাবি, ছাত্রী সমর্থন থাকলেও ভীতির কারণে প্যানেলের প্রার্থী পাওয়া যায়নি। বামপন্থি সংগঠনের প্রার্থী সংখ্যাও খুব কম। হলগুলোতে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছে বাম সংগঠনগুলো। ঢাবিতে পাঁচটি ছাত্রী হলে ভোটার রয়েছেন ১৫ হাজার।

২০১২ সালে ঢাবির ২৫ জন শিক্ষার্থীর করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করতে আদেশ দেন। পরের মাসে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেয়, ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে এই নির্বাচন হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকে ডাকসু নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়।

এর আগে সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচন হয়। দেশের শিক্ষা, স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশে উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যায়তনটির রাজনৈতিক অর্জন-অবদানও কম নয়। নেতা তৈরির আঁতুড় ঘর বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ডাকসু)। ডান, বাম, মধ্যপন্থা— সব দলেই ডাকসুর সাবেক নেতাদের সক্রিয়-সগৌরব অংশগ্রহণ রয়েছে। ছাত্রদের অধিকার আদায় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনাকারী সংগঠন ডাকসু।

শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নির্বাচন হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচন হয় কিন্তু যে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের নির্বাচনটিই অনুষ্ঠিত হয় না। অনেকে মনে করেন, ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার ভয়ে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়নি।

১৯২১ সালে উপমহাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ডাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এক টাকা চাঁদা দিয়ে এর সদস্য হতে হতো। এভাবেই যাত্রা শুরু হয় দেশের স্বাধিকার, ভাষার সংগ্রাম ও স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার ডাকসুর। মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজউদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। ১৯২৮-২৯ সেশনে ভিপি ও জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন এ এম আজহারুল ইসলাম ও এস চক্রবর্তী।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ডাকসু,ডাকসু নির্বাচন,ঢাবি,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close