সাধন সরকার

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

স্মার্ট রাজধানী চাই

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘উড়োজাহাজ চড়ে শহরগুলো দেখলে মনে হয় পৃথিবীর চর্মরোগ।’ একসময়ের তিলোত্তমা ঢাকা এখন যন্ত্রণার আরেক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব নাগরিক চায় তার রাজধানী শহর হবে আধুনিক সবুজবেষ্টিত এক স্মার্ট শহর। কিন্তু এ ‘শহরটাকে’ কেউ কখনো আপন ভাবতে পারেননি!

ফলে পরিকল্পনাহীন ঢাকা যা হওয়ার তাই হয়ে বসে আছে। ১৬১০ সালে রাজধানীরূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয়। ঢাকা ‘পৌরসভা’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৪ সালে। ঢাকা সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয় ১৯৯০ সালে। এখন দুই সিটি করপোরেশন দুই দিক থেকে উন্নয়ন করছে। তবু ঢাকার এ হাল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা নগরের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে প্রায় ৪০ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কোনো সমন্বয় কি আছে? আড়াই হাজার বছর আগে প্লেটো তার বিখ্যাত বই ‘রিপাবলিক’-এ আদর্শ শহর ও তার জনসংখ্যা সম্পর্কে বলেছেন, ‘একটি নগর রাষ্ট্র ততটাই বড় হবে, যাতে তার সব নাগরিকের উপস্থিতিতে জনসভা করা যায়।’ এর মাধ্যমে তিনি শহরের জনসম্পৃক্তার কথা বলেছেন। যেটি ঢাকা শহরের নেই বললেই চলে।

আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা ২০১৮ সালে বৈশ্বিক বাসযোগ্যতার জরিপে বিশ্বের ১৪০টি নগরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম সারির দিকে। ঢাকা যেন এক আজব নগরী! বিশ্বের ১১তম জনবহুল শহর, যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা দেড় কোটির বেশি। এর মধ্যে বস্তিবাসী প্রায় ৪০ লাখের মতো।

২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকায় যানজটের কারণে অর্থনীতির বার্ষিক ক্ষতি ২ হাজার কোটি ডলার। বাতাসে সিসার পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়েছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে বিল্ডিংগুলো অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ এখানে নিত্যসঙ্গী। নদী হয়েছে নর্দমা। জলাশয় হয়েছে আবর্জনা। আর বর্ষাকাল এখন একটি অব্যর্থ যন্ত্রণা। জলাবদ্ধতা তার প্রমাণ। সবকিছু যেন ঢাকাতেই হওয়া লাগবে! ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকায়। ভালো বদলি-নিয়োগ-বাণিজ্য নাকি ঢাকায়! নগরবাসীর আবাসন ব্যবস্থার নামে এখানে চলছে তেলেসমাতি কারবার। বস্তিবাসী, ভিক্ষুক ও হকারদের নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই।

ঢাকার পাশের ৪টি নদীর দখল-দূষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে। পরিবেশ অধিদফতর অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গার পার ও নিকটবর্তী প্রায় ২ হাজার, শীতলক্ষ্যায় সাড়ে ৭০০ এবং তুরাগ ও বালু নদের এলাকার ছয় লক্ষাধিক কল-কারখানার বর্জ্য সরাসরি যাচ্ছে এসব নদীতে। এ নদীগুলোই যে সভ্যতার প্রাণ! ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থা এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে। আর নারীবান্ধব একটা শহর আমরা এখনো গড়ে তুলতে পারেনি।

তবে আশার কথা, ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তারের সরকারি উদ্যোগ সফল হয়েছে। এখন যেসব বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে তা হলো —১. ঢাকার সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াসী ডিটেইলড এরিয়াপ্ল্যান (ড্যাপ ) এ বিশদ পরিকল্পনাটি একুশ শতকের সোনার বাংলা গড়ার একটি মাইলফলক। এ ড্যাপ প্রকৃতির ওপর যান্ত্রিকতাকে নির্মূল করে ঢাকাবাসীর জীবন ও ৪০০ বছরের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবে— এমনই প্রত্যাশা সবার। ২. শহরের বাইরের বনভূমি ও জলাভূমির সঙ্গে শহরটা সবুজ ও জলের করিডরের মাধ্যমে সংযুক্ত রাখতে হবে।

৩. দুভাবে শহরকে গড়ে তুলতে হবে। যে শহর নির্মিত হয়ে গেছে তাকে যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে উন্নত করা। আর যে শহর গড়ে উঠবে তার মানদন্ড নিশ্চিত করা। ৪. ফুটপাত উদ্ধারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা, ট্রাফিক আইন মান্য করা, নির্দিষ্ট লেন মেনে গাড়ি চালানো— এ ব্যাপারে সবার সতর্কতা জরুরি। সর্বোপরি ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে দেশের সব অঞ্চলে উন্নয়নের ভারসাম্য আনা দরকার। রাজধানীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অবসান ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। এজন্য সরকারি সিদ্ধান্তের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও প্রয়োজন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঢাকা,রাজধানী,ঢাকা শহর,ঘনবসতি,স্মার্ট শহর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close