আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮

প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্য

সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান মানুষকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে, যা জীবনযাপনকে করেছে সহজতর। কিন্তু বিজ্ঞানের সেই আশীর্বাদ মানুষের বিবেচনার অভাবে পরিণত হয়েছে অভিশাপে। প্লাস্টিকবর্জ্য তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার আজ অপরিহার্য। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বিকল্প সামগ্রী হিসেবে পলিমারের ব্যবহার হচ্ছে।

ক্যারি ব্যাগ থেকে ওষুধের বোতল, খাদ্য পরিবেশনের পাত্র থেকে ফুলেব টব পর্যন্ত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চটের ব্যাগ হোক কিংবা কাচের শিশি অথবা চীনেমাটির থালা কিংবা মাটির টব ইত্যাদির পরিবরর্তে বিকল্প হিসেব ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। অপেক্ষাকৃত সস্তা, বহনযোগ্য হওয়ার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছ পলিমারে তৈরি সামগ্রী। এর ব্যবহার নিয়ে আপত্তি নেই, কিন্তু ব্যবহারের পর যেভাবে এগুলিকে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আপত্তি তাতেই।

সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় তারা ব্যবহার করা প্লাস্টিকের সামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে। যেহেতু প্লাস্টিকের সামগ্রী মাটিতে মিশে যায় না, এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই ক্রমেই তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে লোকালয়ের বুকে। আর তা থেকেই ছড়াচ্ছে দূষণ। পলিমার সামগ্রী পুড়িয়ে ফেললে আরো বিপদ, হাইড্রো-কার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা।

সমীক্ষা বলছে, যেভাবে দূষণ বাড়ছে তাতে ২০৫০ সালে সমুদ্রে মাছের তুলনায় প্লাস্টিকের সংখ্যা বেশি হবে। এর মোকাবিলা কীভাবে হবে, তা নিয়ে নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। এর মধ্যেই খবর মিলেছে, অ্যামেরিকায় আগামী এক দশকে প্লাস্টিকের উৎপাদন বাড়বে ৪০ শতাংশ। কোথায় যাবে এই বিপুল বর্জ্য? এ যেন গোটা পৃথিবীর দূষিত আস্তাকুঁড় হয়ে ওঠার অশনিসংকেত! সাধারণ প্লাস্টিকের ব্যাগগুলির শতকরা ১০০ ভাগই কৃত্রিম পলিথিনের, যা জীবাশ্মের অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি? এই ব্যাগগুলো মোটেই পরিবেশবান্ধব নয় এবং এগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ বছর সময় লাগে।

কিছু ব্যাগ আছে ‘ইউজ এন্ড থ্রো’। একবারই ব্যবহার করা করা এগুলো। এমন প্লাস্টিকের ব্যাগে রয়েছে শতকরা ৭০ ভাগ রিসাইক্লিং পলিথিন। জৈবিক উপায়ে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়, এমন প্লাস্টিক ব্যাগ পাওয়া যায় আজকাল। তবে সেই সব প্লাস্টিকের ব্যাগ সাধারণত শতকরা ৭০ ভাগ অপরিশোধিত তেল এবং ৩০ ভাগ নবায়ণযোগ্য কাঁচামাল থেকে তৈরি। এতে পুনঃউৎপাদনেও সীমাবদ্ধতা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলেন। এতে পরিবেশও দূষণ হয়। তবে কম মাত্রায়। অন্যদিকে কাগজের ব্যাগ যেসব সময়ই পরিবেশবান্ধব, অর্থাৎ কৃত্রিম ব্যাগের তুলনায় ভালো – তাও কিন্তু নয়। কারণ, এ সব ব্যাগ তৈরিতে অনেক বেশি সময় এবং ব্লিচিং করার জন্য শক্তিশালী রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা পরে আবার রাসায়নিক উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। এতে কিছুটা হলেও দূষণ ঘটে।

২০১৮ সালের গোড়াতেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে জানিয়েছেন, ২০৪২ সালের মধ্যে ব্রিটেনকে সম্পূর্ণ প্লাস্টিকমুক্ত করাই তাঁর লক্ষ্য। একটি স্লোগানও দিয়েছেন তিনি, ‘ক্লিনার, গ্রিনার ব্রিটেন।’ সুপারমার্কেটগুলির কাছে তাঁর আবেদন ‘প্লাস্টিকের ব্যবহার স¤পূর্ণ বন্ধ করুন।’ এরকম পরিকল্পনা আমরাও গ্রহণ করতে পারি। মন্দ নয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এ আহবান। লুক্সেমবুর্গ, ডেনমার্কের মতো বহু দেশ প্লাস্টিক ব্যাগের

ওপর বিপুল পরিমাণ কর বসিয়েছে। জার্মানির সুপারমার্কেটগুলি প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে বার বার ব্যবহার করা যায় এমন অন্য ব্যাগের ব্যবহার চালু করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমশ কমছে। এরকম পরিকল্পনা আমরাও হাতে নিতে পারি। প্লাস্টিক বা পলিমার জিনিসপত্রের উপর বেশি পরিমানে কর বসিয়ে প্লাস্টিক সামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দিতে পারি। অন্যদিকে পাট বা পরিবেশবান্ধব জিনিসপত্রে ভর্তুকি দিয়ে ও সাহায্য সহযোগিতা করে দাম কমিয়ে ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগী হতে পারি।

২০১৭ সালের শেষের দিকে সুদূরপ্রসারী এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেনিয়া। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কেনিয়ার কোথাও প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন করা যাবে না। ব্যবহারও করা যাবে না। কেউ নতুন নিয়ম না মানলে তার চার বছর পর্যন্ত জেল এবং ৩৮হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, মাসে কেনিয়ায় প্রায় ২৪ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হতো। এর সুফল পেয়েছে কেনিয়া। কমতে শুরু করেছে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার। আমাদের দেশেও পলিথিন ব্যবহারে আইন আছে। তবুও ব্যবহার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে পরিবেশের স্বার্থে। প্রয়োজনে আইনকে আরো যুগোপযোগী করতে হবে। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০০ বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। কারণ, ব্যবহৃত প্লাস্টিক শেষ পর্যন্ত নদী, সাগর ও কৃষি জমিতে স্থান পায় এবং সেসব গলতে বা টুকরো হতে বহু বছর সময় লেগে যায়। এর ফলে মাটি ও পানির দূষণ অব্যাহত থাকবে।

ব্যাগ এবং প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন হতে পারে পাটের মতো পরিবেশবান্ধব পণ্য দিয়ে? পাট যেমন স্বাস্থ্যকর সবজি, তেমনি পাট থেকে তৈরি হয় মজবুত সুতা। তাছাড়া পাট প্রাকৃতিক আঁশ এবং দামেও সস্তা। ব্যবহারের দিক থেকে তূলার পরেই পাটের স্থান । তাছাড়া পাট মজবুত ও টেকসই হলেও তা রিসাইকেল করাও সম্ভব। পাটের তৈরি ব্যাগ দেখতে সুন্দর, আধুনিক ও মজবুত। এই ব্যাগ ব্যবহারে যেমন পকেটের পয়সা বাঁচবে, তেমনি পরিবেশ সুরক্ষাও হবে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্লাস্টিক,বিকল্প পণ্য,পাট,পাট পণ্য
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close