মোতাহার হোসেন

  ৩০ অক্টোবর, ২০১৮

মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জন

বাংলাদেশ বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়নে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে প্রতিনিয়ত। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা সামগ্রিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীশিক্ষা, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষমতা, দারিদ্র্য হ্রাস, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জনসহ প্রভৃতি খাতের উন্নয়ন, মাথাপিছু আয়, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মানের উন্নতির কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়, ‘বিশ্ব পরিমণ্ডলে ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ছে বাংলাদেশের। এবার বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ভ্যালু র‌্যাংকিংয়ের লাল-সবুজের দেশ লাভ করেছে ৩৯তম স্থান। আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪৪তম। এর আগে আরেকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশে ‘মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতি’ তথ্য প্রকাশ করেছে। এ দুটো সংবাদই আশাব্যঞ্জক এবং বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া ও সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত থাকবে অনাগত দিনেও।

এজন্য একটু পেছনে যাওয়া দরকার তা হলো, যেকোনো সরকারের প্রধান লক্ষ্য ও এজেন্ডা হওয়া উচিত জনগণের উন্নয়ন, কল্যাণ ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করা। বাংলাদেশে নির্বাচনকালে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ম্যানুফেস্টোতেও এ বিষয়গুলো তাদের অঙ্গীকার হিসেবে থাকে। পরে ক্ষমতায় গিয়ে অনেক সময় এসব ওয়াদা যথাযথভাবে পালন করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটেছে একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে। তিনি দুই মেয়াদে টানা দশ বছর রাষ্ট্র পরিচালনায় তার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করেছেন শতভাগ। এর সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ। বিশ্বে এখন বাংলাদেশ সত্যিই ‘উন্নয়নের রোল মডেল’।

সব ধরনের উন্নয়নের প্রধান লক্ষ্য দেশের মানুষের কল্যাণ ও তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সব উন্নয়ন প্রত্যাশিত পথেই এগোচ্ছে। এর স্বীকৃতি মিলেছে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকেও। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে চলমান বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বার্ষিক সম্মেলনে প্রকাশিত বৈশ্বিক মানবসম্পদ সূচকে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা।

দেশে মানবসম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি নারী-পুরুষের বৈষম্য হ্রাস এবং নারী উন্নয়নের সূচকেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যা আমাদের অবশ্যই আশান্বিত করে। প্রত্যাশিত আয়ু, সাক্ষরতা, শিক্ষা ও মাথাপিছু আয়সহ অনেক সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। দেখা যায়, বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া একটি শিশু বিদ্যমান পরিবেশে শিক্ষা নেওয়ার পর পূর্ণ বয়সে তার উৎপাদনশীলতা হবে ৪৮ শতাংশ। ভারতে এই হার ৪৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ৩৯ শতাংশ।

সূচকের শীর্ষে থাকা সিঙ্গাপুরে এই হার ৮৮ শতাংশ। বাংলাদেশে একটি শিশু ১৮ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত গড়ে ১১ বছর স্কুলে কাটায়। ভারতে এ সময় ১০ দশমিক ২ বছর এবং পাকিস্তানে ৮ দশমিক ৮ বছর। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে এখন যাদের বয়স ১৫ বছর, তাদের মধ্যে ৮৭ শতাংশের প্রত্যাশিত আয়ু হবে ৬০ বছরের বেশি। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা একই কাতারে। ভারতে প্রত্যাশিত আয়ুর এই হার ৮৩ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৮৪ শতাংশ। এতে দেখা যায়, মানব উন্নয়ন সূচকের প্রায় সব বিচারেই বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। এসবই স্বাধীনতার ফসল। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আমাদের প্রত্যাশিত অর্জনকে আরো বেগবান করতে পারে। এখন এদিকে নজর দেওয়া উচিত।

এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো সাফল্য আমাদের আনন্দিত করে, উজ্জীবিত করে। সেটি ক্রিকেটের সাফল্য হোক, কিশোরী মেয়েদের ফুটবল জয়ের সাফল্য হোক কিংবা অর্থনীতির কোনো ক্ষেত্রের সাফল্যই হোক। জয়ের এ ধারায় বাংলাদেশকে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রত্যাশিত আয়ু ও উৎপাদনশীলতায় আমাদের অবস্থান বৈশ্বিক বিবেচনায় এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। দ্রুত আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কার্যকর ও মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান কমাতে হবে। লৈঙ্গিকবৈষম্য দূর করতে হবে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ কোনোক্রমেই পিছিয়ে থাকতে পারে না, এই বিশ্বাস আমাদের থাকতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের মানবসম্পদ সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম অবস্থানে রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দুই নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সূচকে ভারতের অবস্থান ১১৫ ও পাকিস্তানের ১৩৪তম। একসময় পর্যায়ক্রমে দুটি দেশেরই অধীনে থাকার ফলে মানবসম্পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকে তাদের টপকে যাওয়া আনন্দ ও কৃতিত্বের, তাতে সন্দেহ নেই। এগিয়ে যেতে হবে আরো বহুদূর। বস্তুত জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বেঁচে থাকার অনুষঙ্গগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে মানবসম্পদ সূচকটি তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার, স্কুলে পাঠগ্রহণের সময়কাল, শিক্ষার মান, প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত ৬০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকা ও শিশুদের সঠিক আকারে বেড়ে ওঠার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এসব খাতে পর্যায়ক্রমে আমরা উন্নতি করলেও আরো বেশি উন্নতির যে সুযোগ আছে, তা বিভিন্ন জরিপ ও মূল্যায়নে উঠে এসেছে।

এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত মানবসম্পদ সূচকে অগ্রগতির এ ধারা কীভাবে ক্রমবর্ধমান করা যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে আরো বেশি উন্নয়ন সম্ভব, তা খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের চেয়ে এগিয়ে থাকা শ্রীলংকা ও নেপালকে পেছনে ফেলে পর্যায়ক্রমে এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে পালা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হবে না। শীর্ষে থাকা সিঙ্গাপুর, হংকং ও জাপান তো আমাদেরই দূর প্রতিবেশী। আশার কথা, একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অবজ্ঞা করা এ ভূখ- নিজের স্বাধীনতার অপরিহার্যতা, সক্ষমতা প্রমাণের পাশাপাশি বিশ্বের চোখে সমীহ আদায় করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। আশাব্যঞ্জক তথ্য, বাংলাদেশের মানবসম্পদ সূচকে পুরুষের চেয়ে নারীরা এগিয়ে রয়েছেন। সম্প্রতি ক্রিকেট ও ফুটবলে সফলতার সাক্ষর রেখেছেন তারা; গার্মেন্ট, কৃষি ও অন্যান্য খাতে তাদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈশ্বিক ব্র্যান্ড মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যান্ড ফাইন্যান্স প্রকাশিত ‘নেশন্স ব্র্যান্ডস ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ভ্যালুর অর্থের পরিমাণ ২৫ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। সূচকে শীর্ষে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ব্র্যান্ড মূল্য ২৫ লাখ ৮৯ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার। এরপরের অবস্থানে চীন, জার্মানি ও ইংল্যান্ড। প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান নবম স্থানে। ব্র্যান্ড ফাইন্যান্স বিশ্বের প্রথম ১০০টি দেশের ব্র্যান্ডসূচক তৈরি করেছেন। এতে পদ্ধতি হিসেবে ‘রয়্যালটি রিলিফ’ মেকানিজম ব্যবহার করা হয়েছে। ব্র্যান্ড ফাইন্যান্সের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগের মূল্যায়ন, সমাজ, পণ্য, সেবা এবং জিডিপির ভিত্তিতে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে। একটি দেশের জাতীয় ভাবমূর্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে বিনিয়োগে উৎসাহ বাড়ে ও বৈশ্বিক বাজারে রফতানির মূল্য বাড়ে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির এ ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাংলাদেশ,মানব উন্নয়ন,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close