শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ
একাদশ জাতীয় নির্বাচন
সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সর্বমহলে এখন আলোচনা হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে। টেলিভিশনে টকশোর আলোচনার বিষয় এখন এটি। কারণ, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে বহু আলোচনা হয়েছে। সর্বজনস্বীকৃত হতে পারেনি ওই নির্বাচনটি। আগামী সংসদ নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে, এ ধরনের একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে সর্বসাধারণের মাঝে।
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, বিরোধী পক্ষের সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না এবং সংবিধান মোতাবেকই নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি তাদের এক সমাবেশ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কয়েকটি পূর্বশর্ত আরোপ করেছে। এসব শর্তের মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার কথাও রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলোর রাজনীতিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশ। কিছু দিন আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে। আগামী নির্বাচনই দলটির এ সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল তা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেছেন।
প্রতিনিধি দলের নেতা জিন ল্যামবার্ট বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং বলে অভিহিত করে বলেছেন, তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চান। নির্বাচন কমিশন যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং ভোটাররা স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তার নিশ্চয়তাও তারা দেখতে চান। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক কয়েক দিন আগে বলেছেন, আমরা বাংলাদেশের ঘটমান পরিস্থিতির দিকে ঘনিষ্ঠ নজর রাখছি। আমাদের মূলনীতি হলো, এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হতে পারে। জাতিসংঘ এমন একটা নির্বাচনই প্রত্যাশা করে। উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না—অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন শুধু আন্তর্জাতিক মহল চায় না, তাবৎ জনগণও চায়।
অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। আমাদের দেশে সমস্যা হলো, আমরা দল ও সরকারকে আলাদা করে দেখার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। নিয়ম হচ্ছে, দল দলের জায়গায় থাকবে; সরকার সরকারের জায়গায়। দল ও সরকার যদি এক হয়ে যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে তা সামাল দেওয়া কঠিন। এ জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার আইনের শাসন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা অনেকটাই স্বচ্ছ। ভারতে যে নির্বাচনগুলো হচ্ছে, তাতে নির্বাচন কমিশন প্রশাসনকেই কাজে লাগাচ্ছে। জেলা পর্যায়ের নির্বাচনে ডেপুটি কমিশনার হচ্ছেন প্রধান। ডেপুটি কমিশনার যখন নির্বাচন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন, তখন ভারতের কোনো রাজনৈতিক দল তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলে না যে, সে নিরপেক্ষ নয়। প্রশ্ন হলো, ওখানে একজন ডেপুটি কমিশনার নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারছে। অথচ, আমাদের এখানে কেন পারছে না? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।
কয়েক দিন আগে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বলেছেন, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ বক্তব্য অবশ্য দেশি-বিদেশি সব মহলের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। বস্তুত দেশে একটি স্থায়ী স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। এ অবস্থায় সরকার, সরকারি দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে সংকটের নিষ্পত্তি করবে, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে দেশবাসী। কারণ, দেশের জনগণ সংঘাতের রাজনীতি দেখতে চায় না। গত ৪৭ বছর ধরে দেশবাসীকে সংঘাত ও সংঘর্ষ দেখতে হচ্ছে। সংঘাত, সংঘর্ষের এই অসুস্থ ধারা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমান সংকট বস্তুত পারস্পরিক অনাস্থা থেকে উদ্ভুত। এ অনাস্থা দূর করতে হলে উভয়পক্ষকে একগুঁয়েমি পরিহার করতে হবে। ভাঙতে হবে অযৌক্তিক অনমনীয়তা। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক আন্দোলন সহিংসতার রূপ নিলে তাতে একসময় তৃতীয় কোনো অরাজনৈতিক চক্র জড়িয়ে যাবে। তারা নানা ক্ষেত্রে নাশকতা সৃষ্টির সুযোগ খুঁজবে। রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির আড়ালে নাশকতা ঘটাবে ওই চক্র; যা কখনোই আমাদের কাম্য নয়।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
পিডিএসও/হেলাল