মোতাহার হোসেন

  ১৬ অক্টোবর, ২০১৮

রাখেন আল্লাহ মারে কে?

প্রবাদ আছে, ‘বোবা-বয়রার কোনো শত্রু নেই।’ কারণ, বোবারা কথা বলতে পারে না আর বয়রারা কানে শোনে না। এ জন্য তাদের কোনো শত্রু নেই। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেও তারা তা বুঝতে পারে না। আর বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাগীতিকায় আছে, ‘হরিণা বৈরী অপনা মাংসে।’ এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, সুস্বাদু মাংসের জন্যই হরিণ মানুষের শত্রু। কিন্তু পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে নানা কারণে মাসুষে মানুষে বৈরিতা। হিংসা ও লোভের বশবর্তী হয়ে একে অপরের মুখোমুখি হচ্ছে। এটা সাধারণ হিসেব। বিশেষ করে জমি-জমা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নিয়ে হত্যার মতো পৈশাচিক ঘটনার নজির রয়েছে দেশ-বিদেশে। কিন্তু বাংলাদেশে এর মাত্রা ব্যাপকতর। একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে এ দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতির সূচনা হয়। একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে পরাজয়ের নির্মম প্রতিশোধ নেয়। পরে একই বছরের ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। এ সময় দেশকে পরিচালনা করা হলো পাকিস্তানি ভাব ধারায় এবং স্বাধীনতা বিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশে পুনর্বাসিত করা হয়। একই সঙ্গে জিয়াউর রহমান ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় মহান আল্লাহর অপার রহমতে তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। পরে দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন কাটানোর পর দেশে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরার পর থেকেই শেখ হাসিনাকে হত্যার টার্গেট করে স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্বের ইতিহাসে একটি বর্বরোচিত এবং জঘন্যতম ঘটনা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃৃত্বশূন্য করার জন্য এই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কখনো নিজ বাসভবনে, কখনো জনসভায় আবার কখনো তার গাড়িবহরে হামলা করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই তিনি মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে রক্ষা পেয়েছেন; যা বাঙালি জাতির জন্য একটি বিশেষ রহমত। তাই তো বলা যায়, রাখেন আল্লাহ মারে কে?

১৯৮৮ সালে ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনা তখন বিরোধীদলীয় নেতা। সেদিন চট্টগ্রামে আট দলীয় জোটের মিছিলে পুলিশ ও বিডিআর গুলিবর্ষণ করে। মূলত এটি ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার একটি হীন প্রচেষ্টা। এতে ঘটনাস্থলে মারা যায় ২৪ জন, আহত হয়েছিল শতাধিক। এরপর ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট রাতে ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা চালায়। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টায় টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় ফিরে বেলা আড়াইটায় ধানমন্ডি স্কুলে উপ-নির্বাচনে ভোট প্রদানের পর গ্রিন রোডে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে ভোটের পরিস্থিতি দেখতে যান। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপি কর্মীরা গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী ও নাটোর রেল স্টেশনে প্রবেশের মুখে তাকে বহনকারী রেলগাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। ১৯৯৫ সলের ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় শেখ রাসেল স্কোয়ারের নিকট সমাবেশে ভাষণ দানরত অবস্থায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতার পর আকস্মাৎ একটি মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করা হলে ২০ জন আহত হয়। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পুত্রকন্যাসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য ইমেইলে পুরস্কার ঘোষণার করে ইন্টার এশিয়া টিভি মালিক শোয়েব চৌধুরী। ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভাস্থলের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়। ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতুর কাজ উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। জঙ্গিরা সেখানে বোমা পুঁতে রাখে, যা গোয়েন্দা পুলিশ উদ্ধার করে।

২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে গিয়েছিলেন। সেখানে রাত ৮টার দিকে জনসভাস্থল থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হলে ঘটনাস্থলেই দুজনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালের ৪ মার্চ যুবদল ক্যাডার খালিদ বিন হেদায়েত নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা চালায়। ২০০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালায়। ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলি গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে দেখতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে যান। সেখান থেকে যশোরে ফেরার পথে কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে রাস্তার ওপর বিএনপি ও যুবদলের নেতাকর্মীরা যাত্রীবাহী বাস দিয়ে বেরিকেড দিয়ে তার গাড়িবহরে হামলা চালায়। ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে গুলিবর্ষণ করে জামায়াত-বিএনপির ঘাতক চক্র।

২০১১ সালে শ্রীলঙ্কার একটি সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের শত্রু রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য চুক্তি করে এবং সেজন্য আগাম পেমেন্টও প্রদান করা হয়। সে সময় সেই আততায়ীদের টিম গাড়ি করে কলকাতা বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে ভেস্তে যায় শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা। ২০১৪ সালের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থান পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গি শাহানুর আলম ওরফে ডাক্তার।

এ প্রসঙ্গে একটি কথা প্রসঙ্গিক যে, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) থেকে প্রকাশিত ‘সংবাদ পত্রে বঙ্গবন্ধু’ (প্রথম খণ্ড) এর মুখবন্ধে পিআইবির মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ আলমগীর লিখেছেন, ‘পাকিস্তান আমলে গোটা সময়ে জুড়ে সামরিক স্বৈরশাসকসহ অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু। মামলা, হামলা, হুলিয়া ও জেল-জুলুম সবই চলেছে তার ওপর। অথচ সেই সময় রাজনীতির মাঠে ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ। ফলে তখন মুজিবকে মাঠে ও রাজনীতিতে একাই লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে।’ এটি শতভাগ সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল মানুষ, মানুষের অধিকার আদায়, মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি। এ কারণে তিনি ১৯৫৭ সালের মে মাসে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে দলকে সুসংগঠিত করার পাশাপাশি রাজপথে থেকে দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে মনোনিবেশ করেন। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, দেশের ও দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন, বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন এবং দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেলহত্যা মামলা, একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার সম্পন্ন করে জাতিকে কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়েছেন। পাশাপাশি তার সুযোগ্য নেতৃত্বে দারিদ্র্যকে জয় করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, শিক্ষায় অগ্রগতি, চিকিৎসা, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ দেশের প্রায় সব খাতে ব্যাপক সফলতা অর্জিত হয়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব কারণে বিগত সময়ে বারবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল ও তাদের অনুগত জঙ্গি সন্ত্রাসীরা বাংলার গণমানুষের নেত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের জন্য বারবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বলা যায়, এখনো তারা সেই হীন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সুযোগ পেলেই এই চিহ্নিত ঘাতক চক্র ছোবল দিতে চেষ্টা করবে। তাই এই প্রার্থনা করি, গণমানুষের ভাগ্য উন্নয়নের কাণ্ডারি শেখ হাসিনা; আল্লাহ যেন তার সহায় হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গ্রেনেড হামলা,শেখ হাসিনা,২১ আগস্ট,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close