সোলায়মান মোহাম্মদ

  ২২ জুলাই, ২০১৮

ফলই শেষ কথা নয়

এইচএসসির ফলাফল প্রকাশিত হলো। বিগত বছরের তুলনায় এবার ফল বেশ খারাপ হয়েছে। ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে অধিক ফেলের কারণে ফেলের পাল্লা বিগত বছর থেকে একটু ভারী হয়েছে। এ বছর সারা দেশে ১০টি বোর্ডে পাসের হার ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৬৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। জিপিএ-৫-এর সংখ্যাও এ বছর কমেছে। গত বছর ছিল ৩৭ হাজার ৭২৬ জন। এ বছর ২৯ হাজার ২৬২ জন। সব মিলিয়ে সারা দেশে অকৃতকার্যের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখের বেশি।

প্রতীক্ষার প্রহর শেষে শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ফলাফলটি প্রকাশিত হওয়ায় দেশজুড়ে আনন্দ ও বেদনা উভয়ই বয়ে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত ফল পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী ঢাকঢোল পিটিয়ে বাজনা বাজিয়ে বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে ওঠে। আবার অনেকে কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অকৃতকার্য হয়ে আত্মহননের পথও কেউ কেউ বেছে নিয়েছে। রাজবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির এসআই দুলাল বিশ্বাসের মেয়ে পরীক্ষায় অকৃতকার্যের সংবাদ পেয়েই গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে। মিডিয়ায় খবরটি পড়ে খুব আহত হয়েছি। যদিও এমন ঘটনা নতুন নয়। প্রতি বছরই এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের পর দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। প্রতিবারই শিক্ষক ও অভিভাবকদের অপরাধী ভাবতে শুরু করি। অভিভাবক ও শিক্ষকদের আরো সচেতন হতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী লেখাপড়া নিয়ে অনেক সিরিয়াস এবং কিছুটা ইমোশনালও বটে, তাদের আগে থেকেই কেন বুঝিয়ে রাখা হয় না। আর রেজাল্টের দিন অভিভাবকরা কোথায় থাকেন। সন্তানের শিক্ষাজীবনের এত বড় একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সে একা কেন। তা ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই শ্রেণিকক্ষেই নৈতিক শিক্ষায় শক্ত করে তুলতে হবে। তাদের শেখাতে হবে সফলতা ও ব্যর্থতা একই সুতায় গাঁথা। অভিভাবকদেরও ছেলেমেয়েদের সব ধরনের পরিস্থিতিতেই নিজেকে সামলে নেওয়ার বিষয়টি শেখাতে হবে। মেধাবীরাও ফেল করতে পারে এটা বিস্ময়কর কিছু না। আর ফেল করা মানেই সে খারাপ ছাত্র বা তাকে দিয়ে কিছু হবে না—এমনটা ভাবা মস্ত বড় ভুল। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথমবার অকৃতকার্য হয়ে পরেরবার আবার পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে আমাদের পরিচিতজনের অনেকেই বিসিএসের ভালো ক্যাডারে চাকরি করছেন, এমন নজির এখন আশপাশে তাকালেই দেখা যায়। সুতরাং একবার, দুবার পরীক্ষায় ফেল করা মানে শেষ কথা নয়।

যারা এইচএসসিতে এবার কৃতকার্য হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও বলতে চাই তোমাদের এ কৃতিত্বও জীবনের একমাত্র সফলতা নয়। এইচএসসি পাসই শেষ কথা নয়। শিক্ষাজীবনে রয়েছে আরো একটি বড় ধাপ। বলা যায়, এইচএসসির পরই শিক্ষাজীবন শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, ভালো বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করা এটিই বিগত বছরের ভালো ফলের চেয়ে অধিক গুরুত্বের। যদিও ভালো বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়টি এসএসসি ও এইচএসসির ফলের ওপর কিছুটা নির্ভর করে, তবে সেটিই একমাত্র সম্বল নয়। ভালো বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রয়োজন কঠোর অধ্যবসায়।

অন্যদিকে এটাও ভেবে দেখতে হবে, যেখানে আমরা সব দিক থেকেই এগিয়ে চলছি, সেখানে এইচএসসি ফল গত বছরের চেয়ে খারাপ কেন হলো। এ নিয়ে অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, রেজাল্ট বেশি ভালো হলেও সমস্যা, আবার খারাপ হলেও সমস্যা। তার মতে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাতা অতি সূক্ষ্মভাবে দেখার ফলেই রেজাল্ট কিছুটা খারাপ হয়েছে। আমরাও চাই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা আরো কড়াকড়িভাবে দেখা হোক। তবে কথা হলো শুধু ইংরেজি ও আইসিটিতে ফল বিপর্যয় কেন। বিজ্ঞানসহ আরো অন্যান্য বিষয় রয়েছে সেই বিষয়গুলোয় কিন্তু শিক্ষার্থীরা ঠিকই উত্তীর্ণ হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেছেন, এবার এইচএসসিতে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেনি। সে কারণেই ফল একটু খারাপ হয়েছে। তার মানে হলো পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে হলে ফল খারাপ হয় এবং সেটি ইংরেজি ও আইসিটিতে বেশি হয়। এতেই প্রমাণ হয় ইংরেজি ও আইসিটিতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা কম। হাতের কাছেও কিছু স্কুল-কলেজে দেখেছি আইসিটির অবস্থা কত খারাপ। শিক্ষার্থীদের বই দেখে দেখে শুধু মুখস্থ করানো হয়। সৃজনশীল পদ্ধতি যেখানে শিক্ষকদেরই পুরোপুরি নখদর্পণে নেই, সেখানে শিক্ষার্থীদের কীভাবে শেখাবে। ইংরেজির অবস্থা আরো খারাপ। নির্দিষ্ট কিছু গাইড সব সময় শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। কিছু কিছু স্কুল-কলেজ আছে যারা বিভিন্ন গাইড বইয়ের কোম্পানির কাছ থেকে টাকা খেয়ে তাদের স্কুল-কলেজে তা বুকলিস্ট হিসেবে দিয়ে দেয় এবং শ্রেণিকক্ষে তাই পড়ানো হয়। নির্দিষ্ট কিছু সিন-আনসিন, প্যারাগ্রাফ, কমপ্লেটিং সেনটেন্স ও রি-অ্যারেঞ্জ পড়ানো হয়। সৃজনশীলতার দিকে নজর খুব কমই দেওয়া হয়।

এমপিওভুক্ত কলেজগুলোয় পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষের সমস্যা থাকে। আবার ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাও বেশি আর তা ছাড়া ইংরেজি বিষয় কমবাইন্ড হওয়ায় সব বিভাগের শিক্ষার্থীদেরই একত্রে শ্রেণিকক্ষে বসতে হয়। যে কারণে অনেকে পেছনে বসে স্যারের পাঠদান সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তা ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের যতটুকু এগিয়ে নিচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিক ততটুকুই পিছিয়ে দিচ্ছে। অ্যান্ড্রয়েট মোবাইলের অপব্যবহার বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার বারোটা বাজানোর অন্যতম একটি কারণও বটে। রাত জেগে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা ফেসবুক, টুইটার ইউটিউবসহ নানা গেমসে আসক্ত হয়ে উঠছে। যে কারণে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার প্রতি দিন দিন অনেকাংশেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ফলে পরীক্ষার ফলও খারাপ হচ্ছে। এমতাবস্থায় অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে। শিক্ষকদেরও আন্তরিকতার সঙ্গে পাঠদান দেওয়া এবং তা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই আমরা ভালো ফলাফলের আশা করতে পারি। শিক্ষার্থীদেরও সব সময় মাথায় রাখতে হবে অকৃতকার্য হলেই সব শেষ নয়। কোনো কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল না হলে পরের বছর আরো দ্বিগুণ প্রস্তুতি নিয়ে এবার যারা ভালো রেজাল্ট করেছে, তাদের থেকেও ভালো রেজাল্ট করে দেখিয়ে দেওয়ার তীব্র বাসনা মনের মধ্যে জাগাতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এইচএসসি,পরীক্ষার ফল,কলাম,মতামত
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist